এমআরটি-২, ৪: ঋণের ফাঁদ ও পরিশোধের সক্ষমতা বিবেচনায় নেওয়ার আহ্বান
রাজধানীর যানজট কমাতে চারদিকে চলছে মেট্রোরেলের (এমআরটি-৬ লাইন) বিশাল কর্মযজ্ঞ। ইতোমধ্যে, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল যাতায়াত শুরু করেছে। নভেম্বরে যাবে মতিঝিল পর্যন্ত। মেট্রোরেল-১ এবং মেট্রোলাইন-৫ এর কাজও চলছে। নতুন করে কাজ শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এমআরটি-২ এবং ৪ এর কাজ।
এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে ঋণের ফাঁদ ও পরিশোধের সক্ষমতাও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রোরেলের (এমআরটি-২ ও ৪) কাজ শেষে হবে ২০৩০ সালে। এ প্রকল্প তাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণ হচ্ছে ৬৭ হাজার কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণ ফাঁদ ও পরিশোধের সক্ষমতার ব্যাপারটি অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। কারণ, কয়েক বছর থেকে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প শুরু হয়েছে, এসবই বিদেশি ঋণ। আবার ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে সব কিছু ওলটপালট করে দিচ্ছে। তবে সরকারের পক্ষ ধেকে বলা হচ্ছে আর্থিকভাবে সমস্যা থাকলেও সামাজিকভাবে লাভবান হবে দেশ। তাই রাজধানী ও এর আশেপাশের যানজট কমাতে দেশের স্বার্থে মেট্রোরেল দরকার।
সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফোলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বাংলাদেশের অবকাঠামো ও ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় বেশি করে বিনিয়োগ করতে হবে। আর্থ-সামাজিকভাবে এর ইতিবাচক দিক আছে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
কিন্তু সম্পদ আহরণে সীমাবদ্ধতা রয়েছে উল্লেখ করে মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, ‘এর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কারণ ট্যাক্স জিডিপির অনুপাত ৯ শতাংশের কাছে। আবার বাজেট ঘাটতি ৪ শতাংশের উপরে। সব মিলে বলা যায় পাবলিক এক্সপেন্ডিচার (জনগণের খরচ) বেশি নয়। এজন্য উন্নয়নের সঙ্গে সম্পদ আহরণে লক্ষ্য থাকতে হবে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ করে উন্নয়নে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ধরনের ঋণ চাপে যাতে না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ, অনেক দেশ ঋণ ফাঁদে পড়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের অনিশ্চয়তার আলোকে আমাদের অর্থ ব্যয় ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সাশ্রয়ী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
এবার নারায়নগঞ্জ পর্যন্ত সম্প্রসারণে বিদেশি ঋণ ধরা হয়েছে ৬৭ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য মেগা প্রকল্পে বিদেশি ঋণের কিস্তিু শিগগিরই পরিশোধ করতে হবে। এর সক্ষমতা কতটুকু রয়েছে বাংলাদেশের সেই প্রশ্নও করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. শামসুল আলম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পে আমাদের ঋণ আছে, নিতে হচ্ছে। এটা সত্য। তবে তা সহনীয় মাত্রায়। পরিশোধ সক্ষমতা আছে বলেই বিদেশিরা আমাদের ঋণ দিচ্ছে। জাইকা আমাদের পরম বন্ধু। তারা সব সময় পাশে থাকে। এজন্যই রাজধানীর যানজট কমাতে আগ্রহ দেখিয়েছে, ঋণ দিয়েছে।
ঢাকার যানজট পাশের জেলাতেও কী ছড়িয়ে যাচ্ছে। এজন্য নারায়নগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এক সঙ্গে ঋণ পরিশোধের চাপে পড়বে না দেশ? অর্থনৈতিকভাবে প্রভাব পড়বে না। এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘দেখেন অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়লেও সামাজিকভাবে লাভবান হবে দেশ। কারণ, সাধারণ মানুষ নিরাপদ ও সহজে যাতায়াত করতে পারবে মেট্রোরেলে।’
রাজধানীর চারটি রুটে শুধু মেট্রোরেলেই এক লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। এর মধ্যে বিদেশি জাইকার ঋণ ৮৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ইতিমধ্যে মেট্রোরেল-১ এ মানুষ যাতায়াত শুরু করেছেন। অল্প সময়ের মধ্যে মতিঝিলও যাবে মেট্রোরেল।
কিন্তু রাজধানীতে প্রবেশ করতে নারায়নগঞ্জ থেকেও যানজট লেগে থাকছে। তাই সরকার এবার মেট্রোরেল-২ লাইনে গাবতলী থেকে নারায়নগঞ্জ পর্যন্ত ৩৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার মেট্রোরেল করার উদ্যোগ নিয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও আন্ডারগ্রাউন্ডে এ লাইন করতে খরচ ধরা হয়েছে ৬০ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা।
এর মধ্যে ঋণ ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। বাকি অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় করা হবে। গাবতলী. ঢাকা উদ্যান-মোহাম্মদপুর-জিগাতলা-নিউমার্কেট-ঢাকা মেডিকেল-গুলিস্তান-মতিঝিল-কমলাপুর-মান্ডা-সাইনবোর্ড-নারায়নগঞ্জ পর্যন্ত। বাস্তায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০৩০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এ ছাড়া, মেট্রোরেল-৪ নামে লাইনটি ধরা হয়েছে কমলাপুর থেকে যাত্রাবাড়ি-চট্রগ্রাম রোড-কাঁচপুর-মদনপুর পর্যন্ত। ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ লাইনে খরচ ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণ ধরা হয়েছে ২১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। বাস্তায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০৩০ সালের জুলাই পর্যন্ত।
প্রকল্পটি দুইটি বাস্তবায়ন করতে অর্থের সরবরাহের ব্যাপারে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। তা যাচাই-বাচাই করা হয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী এসে স্বাক্ষর করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সুত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তবে ইআরডি সূত্র জানায়, সাধারণত যেকোনো প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য প্রস্তাব উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সবার কাছে পাঠানো হয়। অনেকে রাজি হলেও আমরা আমাদের দিকটা বিবেচনা করি। কারণ, মেট্রোরেলে এ পর্যন্ত জাপানি ঋণদাতা সংস্থা জাইকা মেট্রোরেলে ঋণ দিয়েছে। তাই এবারও আশা করা যায় জাইকা এগিয়ে আসলে তাদের ঋণে আগ্রহ দেখানো হবে। তারা নিশ্চিতা দিলে সার্বিক ব্যাপারে আলোচনা করে ঋণ চুক্তি হবে। একই সঙ্গে ডিপিপি তৈরি করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা করিশনে পাঠানো হবে।
সূত্র জানায়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের আওতায় রাজধানীতে মেট্রোরেল বাস্তবায়ন করতে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি গঠন করেছে সরকার। এর আওতায় এমআরটি-৬সহ আরও কয়েকটি রুটের কাজ চলছে। এর মধ্যে রাজধানীর যানজট কমাতে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল বা এমআরটি-৬ চলাচল শুরু করেছে। নভেম্বরে মতিঝিল পর্যন্ত চলবে। প্রথমে প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুনে শেষ করার কথা। কিন্তু পরে মতিঝিল পর্যন্ত সম্প্রসারণ করায় খরচ বেড়ে প্রায় সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। এর কাজ শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের জুলাই মাসে। জাইকার ঋণ সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা। বাকি অর্থ সরকার ব্যয় করছে।
এ ছাড়া, মেট্রোরেল-১ প্রকল্পটির কাজও শুরু হয়েছে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে। তা শেষ হবে ২০২৬ সালে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এতে জাইকার ঋণ হচ্ছে সাড়ে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অপরদিকে, ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে মেট্রোলাইন-৫ এর কাজও শুরু হয়েছে। তা ২০১৯ সালের জুলাইতে শুরু হয়েছে, শেষ হবে ২০২৮ সালে। এতে জাইকার ঋণ হচ্ছে ২৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির আওতায় চলমান তিন মেট্রোরেলে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ১৭ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। এতে জাইকার ঋণ হচ্ছে ৮৫ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। বাকি অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় করা হবে।
উল্লেখ্য, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোপথ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে যাত্রী চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হতে পারে। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে রাজধানীর বুকে প্রস্তুত হবে আরও তিনটি মেট্রোরেল পথ। রাজধানীর যানজট কমিয়ে মানুষের যাতায়াত সহজ ও দ্রুত করার লক্ষ্যে বিশ্বের উন্নত দেশের মতো মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগে ২০১২ সালে সায় দেয় সরকার।
সূত্র জানায়, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী মোট ৬ ধাপে মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে পরিকল্পনার প্রথম ধাপে গঠন করা হয় ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। উড়াল ও পাতাল রেলপথ মিলিয়ে ৬ ধাপে রয়েছে, এমআরটি লাইন-৬, এমআরটি লাইন-১, এমআরটি লাইন-৫ এ দুই রুট রয়েছে নর্দার্ন ও সাউদার্ন, এমআরটি লাইন-২, এমআরটি লাইন-৪।
উড়াল-পাতাল মিলিয়ে এমআরটি লাইন-১ এর আওতায় নির্মাণ হবে প্রায় ৩১ কিলোমিটার রেলপথ। ২০১৯ সালে এমআরটি লাইন-১ এর অনুমোদন দেওয়া হয়। লাইনটি বিমানবন্দর থেকে নতুনবাজার, কমলাপুর হয়ে পূর্বাচল পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এটি বিমানবন্দর ও পূর্বাচল এই দুই ভাগে বিভক্ত। একাংশে বিমাবন্দর অংশে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত। এই অংশে মোট ২০ কিলোমিটার পথে পাতালে স্টেশন হবে ১২টি। বিমানবন্দর রুটই হবে বাংলাদেশের প্রথম পাতাল রেল।
আর পূর্বাচল অংশে ১১ কিলোমিটার রুট হবে নতুনবাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো। এই অংশের পুরোটাই উড়াল এখানে স্টেশন হবে নয়টি। এর মধ্যে সাতটি স্টেশন উড়াল পথে আর বাকি দু’টি নদ্দা ও নতুনবাজার এলাকায় পাতাল স্টেশনের সঙ্গে মিলে থাকবে। নতুনবাজার স্টেশনে এমআরটি লাইন-৫ নর্দান রুটের সঙ্গে আন্তঃলাইন সংযোগ থাকবে। নদ্দা ও নতুন বাজার স্টেশন আন্তঃসংযোগ রুট ব্যবহার করে বিমানবন্দর রুট থেকে পূর্বাচলে যাওয়া যাবে।
২০২৮ সালের মধ্যে রাজধানীর সাভারের হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত উড়াল-পাতাল মিলিয়ে মোট ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল পথ নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার হবে উড়াল এবং ৭ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হবে পাতাল। মোট ১৪টি স্টেশনের ৯টি উড়াল পথে আর ৫টি স্টেশন থাকবে পাতাল পথে। এমআরটি লাইন-৫ নর্দার্ন রুট নামে পরিচিত এই অংশের সার্ভে কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে।
আরইউ/এমএমএ/এএস