চেকিংয়ের নামে যত্রতত্র গাড়ি থামানোয় যানজট, ভোগান্তি চরমে
স্পিডে বাইক চলছে। হুট করে সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল ট্রাফিক পুলিশ। তড়িঘড়ি করে ব্রেক কষল বাইকার। এতে পেছনে গাড়িগুলোকেও দ্রুত ব্রেক চাপতে হলো। একটুর জন্য একটির সঙ্গে আরেকটি গাড়ির ধাক্কা লাগল না।
এমন দৃশ্য এখন রাজধানীর প্রায় সর্বত্র। ঈদকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা আরও বেড়েছে। গতিতে থাকা গাড়ি বা মোটরবাইক সিগনাল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে না থামাতে পারলেও সমস্যা। মনে করা হয় পালিয়ে যাচ্ছিল। এর ফলে অহেতুক হয়রানি করারও অভিযোগ গাড়িচালক ও বাইকারদের।
গত শনিবার (১৫ এপ্রিল) কারওয়ান বাজারে বেসরকারি টেলিভশন চ্যানেল বাংলাভিশনের সামনে দিয়ে কারওয়ান বাজার মোড়ের রাস্তা দিয়ে মোটরসাইকেলে আসছিলেন মো. আশরাফুল আলম রিপন। কারওয়ান বাজার মোড়ে আসার পথে রাস্তায় সিগন্যাল দেয় ট্রাফিক পুলিশ। তিনি ট্রাফিকের কথায় দাঁড়িয়ে যান। এ সময় ট্রাফিক পুলিশের সদস্য তৌহিদুল ইসলাম তার কাছে গাড়ির কাগজ চান এবং তিনি কাগজও দেন।
আশরাফুল ওই ট্রাফিক সদস্যকে বলেন, আপনি তো ট্রাফিকের সদস্য, সার্জেট না, তাহলে কাগজ দিয়ে কী করবেন? এটা বলার পর ট্রাফিক সদস্য তৌহিদুল তার উপর চড়াও হন এবং তাকে অকারণে অনেক সময় ধরে আটকে রাখেন।
একই ওয়ান ওয়ে রাস্তা দিয়ে আসছিলেন প্রাইভেট চালক মনির হোসেন। মনিরের গাড়িটি আগের নিয়মেই সিগন্যাল দেন ট্রাফিকের সার্জেন্ট মনজুর ওবায়দুল। ঘটনাস্থলে মনিরের সঙ্গে ঢাকাপ্রকাশ-এর কথা হলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভাই রাস্তায় চলার মতো অবস্থা নাই। রোজার শুরুতেই কিছু কিছু এলাকার ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্টরা অযথা গাড়ি চেক করে হয়রানি করছেন। অনেক সময় ট্রাফিক সদস্যরা বিভিন্ন ইশারায় টাকা চান। যদি সেটা কেউ না বোঝে তাহলে অযথা রাস্তায় সময় নষ্ট করেন এবং মামলার ভয় দেখান। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে তাদের কিছু ‘খরচ’ দেন যেটা আমি ও মাঝে মধ্যে দিয়ে থাকি।
সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও বিভিন্ন যানবাহনের চালকদের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগ পাওয়া যায়। চালকদের অভিযোগ, এমনিতেই রমজানে রাস্তায় যানজট থাকে তারপর আবার যেখানে সেখানে ট্রাফিকের গাড়ি চেক করার কারণে তৈরি হচ্ছে আরও বেশি যানজট।
অবশ্য, এসব বিষয় নিয়ে ট্রাফিকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, সুনির্দিষ্টভাবে যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে ওই সব ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তা ছাড়া, অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কারওয়ান বাজারে কথা হয় ট্রাফিক পুলিশের সদস্য সোবহানের সঙ্গে। সোবহান বলেন, অনেক সময় গাড়ি উল্টাপাল্টা আসে এজন্য আমরা তাদের ধরে মামলা দিয়ে থাকি। আপনারা কি সার্জেন্ট? সার্জেন্ট ছাড়া কি মামলা দিতে পারেন?
এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা প্রথমে গাড়ি আটক করি পরে সার্জেন্টকে ডাকি, সার্জেন্ট এসে চেক করে মামলা দেন।
সাধারণ চালকদের অভিযোগ আপনি অনেক সময় টাকা চান আসলে এটা কতটুকু সত্যি? এমন প্রশ্নের জবাবে সোবহান বলেন, এসব আমরা করি না। যারা এই অভিযোগ করেছেন তারা মিথ্যা কথা বলছেন। আপনি আমাদের বড় স্যারদের সঙ্গে কথা বলেন।
শুধু কারওয়ান বাজার নয় ঈদকে সামনে রেখে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা যেখানে সেখানে গাড়ি চেক করছে এমনটা অভিযোগ করে তিতুমীর কলেজের ছাত্র পাঠাও চালক রেজাউল করিম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমি শাহবাগ থেকে মহাখালী আসার পথে এ পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশ ৪ বার আমার গাড়ি চেক করেছে। কাগজপত্র সব ঠিক থাকায় তারা এই গরমে শুধু শুধু আমাকে হয়রানি করল।
শ্যামলীতে মোবারক নামের এক ট্রাফিক পুলিশ অতিরিক্ত গাড়ি চেক করছে এমনটা জানিয়ে আশুলিয়ার প্রাইভেট চালক শরিফুল ইসলাম বলেন, আমার গাড়ির কাগজপত্র সব ঠিক আছে বলেছি। তারপরও ওই ট্রাফিক সার্জেন্ট মোবারক রাস্তায় অযথা গাড়ি থামিয়ে আমার মতো অনেক মানুষের সময় নষ্ট করছেন এবং গরমে কষ্ট দিচ্ছেন।
বেসরকারি চাকরিজীবী তুষার হোসেন নামের এক ব্যক্তি জানান, রাস্তায় এখন বের হওয়ার মতো অবস্থা নেই। ঈদকে সামনে রেখে মনে হয় ট্রাফিক পুলিশের যেখানে সেখানে গাড়ি চেক করার কাজ বেড়েছে। তারা যানজট নিরসন না করে গাড়ি চেক করার দিকে বেশি খেয়াল দিচ্ছেন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ঈদে এলে তাদের নজর সড়কের থেকে যানবাহনের দিকে চলে যায়।
বাংলামোটর থেকে শাহাবাগ যাচ্ছিলেন সাফায়েত নামের এক চালক। তাকে চলন্ত অবস্থাতেই ডিউটিরত ট্রাফিকের এক সদস্য দাড়াতে বলেন এবং চেক করেন। সাফায়েতকে অনেক সময় ধরে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখেন তিনি।
এ সময় ক্ষিপ্ত হয়ে সাফায়েত বলেন, আমার অপরাধ কী? আমাকে ধরেছেন কেন? তার এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দাঁড়ান সার্জেন্ট স্যার আসুক তিনি কাগজ দেখবেন এবং আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক হাইকোর্ট মোড়ে ডিউটিরত ট্রাফিকের এক সার্জেন্ট বলেন, আমাদের ট্রাফিক কনস্টেবলরা অনেক সময় আমাদের অনুমতি ছাড়া গাড়ি থামিয়ে চেক করেন, যার কারণে আমাদের ট্রাফিক সার্জেন্টেদের সমস্যায় পড়েতে হয়।
তিনি বলেন, বেশ কিছু দিন আগে আমার এক ট্রাফিক কনস্টেবল একদিন রাতে একটি ট্রাক থেকে ২০০ টাকা নিয়েছিল বলে জানতে পারি। ওই সময় আমি রাতে খেতে গুলিস্তান মোড়ে গিয়েছিলাম। পরে টাকা নেওয়া ভিডিওটা ভাইরাল হয় আর আমি উপর মহলের চাপে পড়ি। তাদের জন্য আমাদের সার্জেন্টদের বদনাম হচ্ছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশের প্রধান (অতিরিক্ত কমিশনার) মনিবুর রহমান বলেন, ট্রাফিক সার্জেন্ট ও ট্রাফিক কনস্টেবল সব সময় রাস্তায় কাজ করেন। অনেক সময় চালকেরা অনিয়ম করে ওই সব অনিয়মের কারণে তারা বিভিন্ন যানবাহনের বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের নামে মামলা দেয়। এসব মামলার কারণে অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের নামে মিথ্যা অভিযোগ দেন।
তা ছাড়া, রোজার সময় রাস্তায় একটু যানজট বেশি হয়। তবে কোন ট্রাফিক পুলিশ যদি কাউকে হয়রানি করে বা টাকা পয়সার দাবি করছে এমন যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে বা পাওয়া যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যোগ করেন তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো হয়রানি বা ঘুষের কোনো অভিযোগ এলে অথবা সেটা প্রমাণ হলে অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা হয় এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।’
আরইউ/এমএমএ/