রাজউক: গ্রাহকের নথির সুরক্ষা কতদূর?
কোনোভাবেই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নথির সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। নিয়মিত গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য গায়েব হওয়া, ফাইল গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। সম্প্রতি রেকর্ডরুমে থাকার কথা এমন ১৫০টি ফাইল কর্মচারীদের কক্ষ থেকে উদ্ধার করেছে রাজউকেরই ভ্রাম্যমান আদালত।
রাজউকে গ্রাহকদের নথি চুরি বা গায়েব হওয়া বন্ধ করতে সিস্টেম ডিজিটালাইজ করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও সম্প্রতি ৩০ হাজার গ্রাহকের নথি চুরি হয়েছে। এ অবস্থায় হাইকোর্টও ব্যাখ্যাও চেয়েছে রাজউকের কাছে।
এরও আগে বহুবার রাজউক থেকে নথি হারিয়েছে। অভিযোগ ছিল, রাজউকের ভেতরের একটি চক্রই এইসব নথি চুরি করে। সম্প্রতি কর্মচারীদের কক্ষ থেকে ১৫০টি ফাইল উদ্ধারের পর সেই অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হলো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নথি গায়েব করে তারপর ভবন নির্মাণে অনিয়ম করা হয়। অনিয়ম করলেও রাজউকের কিছু বলার থাকে না। কারণ রাজউকের কাছে কোন প্রমাণ নাই। আর ভবন মালিক দাবি করেন যে প্ল্যান অনুযায়ীই তিনি নির্মাণকাজ করছেন।
অন্যদিকে, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের যে ১৫০টি ফাইল উদ্ধার করা হয়েছে সেসব ফাইলের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের হয়রানি করে ঘুষ চাওয়া হয়। ঘুষ না পাওয়া পর্যন্ত এসব ফাইল আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কাঙ্ক্ষিত টাকা দিলে ফাইল পাওয়া যায়।
এমন অভিযোগ শতশত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পূর্বাচলের এক প্লট বরাদ্দপ্রাপ্ত ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, লিজ দলিল করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাজউক থেকে বলা হয় ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু যখন ঘুষ দিলাম তখন ঠিকই ফাইল পাওয়া গেল।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নথি গায়েব হওয়ার ঘটনা নিয়মিত ঘটার কারণেই ২০১৯ সালে অনলাইনে সেবা দেওয়া শুরু করে রাজউক। কিন্তু অনলাইনে যাওয়ার পরই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গ্রাহকের নথি গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটে।
অনলাইনের নথি প্রিণ্ট করে সংরক্ষণ করবে রাজউক
রাজউকের সার্ভার থেকে গায়েব হওয়া গ্রাহকের ৩০ হাজার নথি উদ্ধার করার পর রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, এখন থেকে অনলাইনের তথ্য প্রিণ্ট করেও সংরক্ষণ করা হবে। পাশাপাশি ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।
নথি গায়েব হওয়ার পর রাজউক জিডি করে নিশ্চুপ থাকার পর যখন বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলো তারপর ঘটনা তদন্তে রাজউকের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), সাইবার পুলিশ ও কম্পিউটার কাউন্সিলও যুক্ত হয়। এখনও এসব প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে কাজ করছে জানান রাজউক চেয়ারম্যান।
এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান আরও জানান, তদন্তকারী সংস্থাগুলো প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে সার্ভার হ্যাক করা হয়েছে। কিন্তু কারা করেছে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
রাজউকের ভেতরেই গড়ে উঠেছে শক্তিশালী চক্র
নথি গায়েবের ঘটনা একরকম নিয়মিত হলেও রাজউকের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কেন জানি সবসময় নীরব থেকেছে বলেই অভিযোগ ভুক্তোভোগীদের। কোনো কারণে ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে তখন একটু নড়েচড়ে বসে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এসব নথি গায়েবে রাজউকের ভেতরেই একটি চক্র গড়ে উঠেছে।
এক সঙ্গে ৩০ হাজার গ্রাহকের নথি গায়েব হওয়ার পরও রাজউক নীরবই ছিল। ঘটনার এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও রাজউক ঘটনা তদন্তে কোনও তদন্ত কমিটিও করেনি। শুধু একটি জিডি করে চুপচাপ ছিল সংস্থাটি। অবশেষে হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করে।
অনলাইনেও নথি গায়েবের ঘটনায় নগরপরিকল্পনাবিদরা রাজউকের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ করে বলছেন, যেকোন অনলাইন স্টোরেজের ক্ষেত্রে ব্যাকআপ থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাকআপ নাই কেন?
সাধারণত নাথি গায়েবের বিষয়ে রাজউকের কেউই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননা। সম্প্রতি ১৫০টি ফাইল কর্মচারীদের কক্ষ থেকে উদ্ধারে নেতৃত্ব দেন রাজউকের সদস্য (এস্টেট) মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম। উদ্ধারের পর নূরুল ইসলাম বলেন, ফাইলগুলো রাজউকের অ্যানেক্স ভবন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ফাইল রেকর্ডরুমে রাখতে বলা হয়েছে।
জানা যায়, অ্যানেক্স ভবন থেকে এর আগেও ৭০টি ফাইল উদ্ধার করা হয়। রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদের নেতৃত্বে তখন অভিযান পরিচালিত হয়। এঘটনায় মোট নয়জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা হয়েছিল।
ওই মামলার এজহারে রাজউক উল্লেখ করে, নথির গতিবিধি খাতায় নিবন্ধন করা হয়নি এবং কাজ শেষে সেগুলো রেকর্ডরুমে না পাঠিয়ে সরিয়ে রাখেন আসামীরা। এছাড়া বিভিন্ন কর্মকর্তার সিল অবৈধভাবে তৈরি করে জালিয়াতির মাধ্যমে বেআইনিভবে ভুয়া নথি তৈরি ও লিজ দলিল সম্পাদন করে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টা করা হয়েছিল।
জানতে চাইলে পরিবেশ ও নগর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রাজউক থেকে নথি গায়েবের অনেক ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু কোন ঘটনারই সুরাহা রাজউক করতে পারেনি বা করেনি।
আরইউ/এএস