জাহাজের নকশা তৈরি
আড়াই বছর মেয়াদী প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি ৭ বছরেও
দেশেই জাহাজের নকশা তৈরির লক্ষ্যে ২০১৫ সালে আড়াই বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ চার দফা বাড়িয়েও শেষ করা যায়নি কাজ। সর্বশেষ ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এই যাত্রায়ও সেটি সম্ভব হয়নি। এই অবস্থায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, জাহাজ শিল্পের বিকাশে ও বৈদেশিক অর্থ ব্যয় কমাতে দেশেই জাহাজের নকশা তৈরি উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য সরকার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিপ মডেল টেস্টিং সেন্টার (টোয়িং ট্যাংক) স্থাপনের জন্য ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর একটি প্রকল্পে অনুমোদন দেয়। ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে আড়াই বছরে অর্থাৎ ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার কথা। দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে গত বছরের জুন মাসের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। সে লক্ষ্যে গত অর্থবছরে প্রকল্পটি সমাপ্ত প্রকল্পের তালিকায় রাখা হয়। কিন্তু সেটি আর শেষ করা যায়নি। বরং আবারও এক বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
জানা গেছে, ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের আসবাবপত্র কেনাসহ বিভিন্নখাতে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু গত সাত বছরে প্রকল্পের আসল কাজ অর্থাৎ শিপ মডেল টেস্টিং সেন্টার (টোয়িং ট্যাংক) স্থাপনের ইকুইপমেন্টই কেনা যায়নি।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করতে প্যাসেঞ্জার ও কার্গো ভেসেলের উপর গবেষণা ও উন্নয়ন সাধন করতে বুয়েট শিপ মডেলিং টেস্টের জন্য এই প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়। যাতে সহজে ও সাশ্রয়ী মূল্যে জাহাজের নকশা করা যায়।
প্রসঙ্গত, ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানের সমুদ্রগামী ৩৩টি জাহাজ তৈরি করে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেছে।
জানা গেছে, এই প্রকল্পের জন্য সরকারের কোষাগার থেকে ৪৪ কোটি টাকা এবং অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশ সংগঠন থেকে ৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। কিন্তু পরবর্তিতে অ্যাসোসিয়েশন থেকে অর্থ ব্যয়ে অপরাগতা প্রকাশ করলে প্রকল্প টোয়িং ট্যাংকের যন্ত্রপাতি আর কেনা সম্ভব হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে কাটছাট করতে হয়েছে। তাই ব্যয় বৃদ্ধি না করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে সংশোধন করে প্রথমে এক বছর সময় বৃদ্ধির অনুমোদন দেয়। এরপর পুরো অর্থ সরকার থেকে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত হয়।
এই প্রকল্পের ১৮টি অঙ্গের মধ্যে ১৫টির কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। তিনটির কাজ প্রায় ৮৬ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু শেষ হয়নি জাহাজের নকশা প্রণয়নের জন্য শিপ মডেল টেস্টিং সেন্টার স্থাপনে ইকুইপমেন্ট কেনার কাজ। গত জুন পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। তবে আর্থিক অগ্রগতি খুবই কম প্রায় আট কোটি টাকা বা ১৬ শতাংশ।
এই অবস্থায় বাকি কাজ শেষ করতে বুয়েট থেকে প্রকল্পটি চতুর্থবারের মতো সংশোধন করতে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এ জন্য প্রকল্প প্রণয়ন, সংশোধন ও অনুমোদন গাইডলাউন অনুসরণ করে একনেক সভায় উপস্থাপন করে অনুমোদন নিতে হবে।
সংশোধনের ব্যাপারে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগকে (আইএমইডি) মতামত দিতে হয়েছে। তাদের মতামতে বলা হয়েছে-পুরো কাজ শেষ করতে এক বছর সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে। কর্মপরিকল্পনা করে চলমান কাজ ত্বরান্তিত করতে ঠিকাদারের মোবিলাইজেশন বৃদ্ধির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার তদারকি জোরদার করতে হবে। বর্ধিত মেয়াদে কাজ শেষ করতে প্রয়োজনীয় অর্থ অবমুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই পিসিআর আইএমইডিতে পাঠাতে হবে।
প্রকল্পটি একনেক সভায় উপস্থাপনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ থেকেও সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিভাগের সদস্য (সচিব) মোসা. নাসিমা বেগম গত বছরের ১১ ডিসেম্বর সুপারিশে বলেছেন, প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া চতুর্থ ও শেষবারের মতো এক বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ নির্ধারণ করা যেতে পারে।
সূত্র জানায়, আগের মতো একনেক সভা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় প্রকল্পটির অনুমোদন পাচ্ছে না। তবে আগামী একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে।
প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ার পিছনে দীর্ঘসূত্রীতার কারণ জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও বুয়েটের নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. গৌতম কুমার সাহা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এই প্রকল্পের টোয়িং ট্যাংকের ইকুইপমেন্ট সহজে পাওয়া যায় না। বিশ্বে মাত্র তিনটা দেশে পাওয়া যায়। প্রথম আন্তর্জাতিক টেন্ডারে কাউকে পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় টেন্ডারে যুক্তরাজ্যের একটি কোম্পানি অংশ নিলেও পরে জানা যায়, সেটি দেউলিয়া। এরপর ২০১৯ সালে করোনায় সব কিছু থমকে যায়। এভাবে বিভিন্ন কারণে দেরি হয়েছে। তবে মূল ভবনসহ অন্যান্য কাজ ২০১৮ সালের মধ্যেই হয়েছে। দেরিতে হলেও তৃতীয়বারের মতো টেন্ডারে সাড়া পেয়ে এলসি খোলা হয়েছে। যন্ত্রপাতিও দেশে এসেছে। মূল ইকুইপমেন্ট ইনস্টলেশনের কাজ চলছে। আশা করি তিন থেকে চার মাসের মধ্যে হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, প্রকল্পটি সংশোধনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে অনেক আগে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করতে হয়ত সময় লাগছে। এ জন্য আগের ডকুমেন্ট অগ্রগতি কম দেখাচ্ছে। টোয়িং টেস্টিং এর ইকুইপমেন্টই প্রায় খরচ বলা যায়। তাই আগে আর্থিক অগ্রগতিও কম ছিলো। এটা কেনার পর প্রায় ৪৯ কোটির মধ্যে এ পর্যন্ত ৪৭ কোটি টাকাই খরচ হয়ে গেছে। অন্যান্য কোনো কাজ তেমন বাকি নেই। বিল্ডিংও হয়ে গেছে। এ প্রকল্পটি বাস্তায়নের ফলে দেশেই জাহাজের নকশা করার পর মডেল করে জাহাজের পারফরম্যান্স পরীক্ষা করার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বৈদেশিক অর্থ ব্যয় রোধ হবে।
এনএইচবি/এএস