শব্দ দূষণ: বাড়ছে স্ট্রোক, শারীরিক ও মানসিক ব্যাধি!
বায়ুদূষণের পর এবার শব্দদূষণেও বিশ্বের শীর্ষ স্থানটি দখল করেছে রাজধানী ঢাকা। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপি এর প্রকাশ করা এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শব্দ দূষণের কারণে রাজধানীতে বসবাসরতরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকরা বলছেন, শব্দ দূষণের কারণে বাড়ছে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ও মানসিক অসুখ।
চিকিৎসকদের দাবি, অতিরিক্ত শব্দ শুধু বিরক্তিরই উদ্রেক করে না, এটি গুরুতর অসুখের কারণ হয়ে দাড়াতে পারে। তাছাড়া শব্দ দূষণে শরীরে যে অঙ্গটি সবচেয়ে প্রথম আক্রান্ত হয় সেটি হল কান এবং শ্রবণশক্তি।
এদিকে স্বাস্থ্য কর্মীরা (থেরাপি বিশেষজ্ঞ) বলছেন, উচ্চমাত্রার শব্দের মধ্যে থাকলে মানুষের শরীরে অ্যাড্রেনালিন হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। বেশি অ্যাড্রেনালিন মানুষের রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের হার বৃদ্ধি করে। তাদের দাবি, অনেক রোগী খিটখিটে মেজাজ, উদ্বেগ, ও নিদ্রাহীনতায় ভোগেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের তথ্য মতে, একজন মানুষ সাধারণত স্বাভাবিকভাবে ৪০ ডেসিবল শব্দে কথা বলে। যাকে বলা হয় বাড়ির ভেতরের শব্দ। সেটিই কানের জন্য সুস্থ মাত্রার শব্দ। মানুষের কান ৭০ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দ সহ্য করতে পারে। কিন্তু এর বেশি হলেই ক্ষতি। দিনের পর দিন যদি লম্বা সময় ধরে কেউ ৭০ ডেসিবলের উপরে শব্দের মধ্যে থাকেন তাহলে শ্রবণশক্তি ক্রমশ কমে যেতে থাকে। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকতে পারে সারাক্ষণ হর্ন বাজানো গাড়িচালক, ট্রাফিক পুলিশ, নির্মাণ কর্মী ও সড়কে দীর্ঘ সময় থাকতে হয় এমন যে কোনো ব্যক্তি।
বিভিন্ন সংস্থার জরিপের তথ্যানুসারে রাস্তায় শুধু গাড়ির হর্ন নয় ঢাকা শহরে ভবন তৈরি, অন্যান্য নির্মাণ কাজ, গ্রিল, টাইলস কাটা, মেশিনে ইট ভাঙা, মাইক বাজানো, জেনারেটরের শব্দ, আতশ বাজির শব্দ থেকে শুরু করে বিভিন্ন উচ্চমাত্রার শব্দে প্রতিনিয়ত শ্রবণশক্তি হারাচ্ছেন অনেক মানুষ।
কারওয়ান বজার মোড়ে কথা হয় ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মঞ্জুরুল ইসলামের সঙ্গে। এসময় সার্জেন্ট মঞ্জুরুল বলেন, পুলিশের চাকরি নেওয়ার আগে আমার কান ভালো ছিল এবং মাথা বেশ ঠান্ডা ছিল। রাস্তায় দিন রাত কাজের কারনে গাড়ির শব্দে কানে একটু কম শুনি এবং মাঝে মধ্যেই মাথা ব্যাথায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকি। তিনি বলেন, শব্দ দূষণ নিয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করলে তারা বলেন, আপনি রাস্তায় কাজ করেন। সড়কে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করেন সেটাই ভালোভাবে করেন তাতে আপনার লাভ হবে।
লালবাগে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকাতে শব্দ দূষণ বেড়েই চলেছে কেউ এই বিষয়ে সতর্ক হচ্ছে না। আমরা রাস্তায় থাকি অনেক সময় অসুস্থ হই। ডাক্তার দেখালে চিকিৎসকরা বলেন, কি কাজ করেন যখন বলি পুলিশের চাকুরী করি ট্রাফিকে আছি, তখন তারা বলেন, কিছু দিন রেস্ট নেন আর না হয় স্ট্রোক, হার্টের সমস্যা বা মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তিনি বলেন, রাস্তাঘাটে শুধু পুলিশ বা গুটিকয়েক লোক এসব শব্দ দূষণ প্রতিরোধ করতে পারবেন না এজন্য সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
চলতি পথে কথা হয় আয়াত পরিবহনের চালক দ্বিন ইসলামের সঙ্গে। এসময় দ্বিন ইসলাম বলেন, রাস্তায় বের হলেই শব্দ দূষণে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। আমিও রাস্তায় মাঝে মাঝে শব্দ দূষণ করে থাকি। শব্দ দূষণ না করে কি করবো? হর্ন না বাজালে অন্যান্য গাড়ির চালকেরা রাস্তায় সাইড দিতে চায় না। এজন্য আমিও বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হর্ন বাজাই। তবে এটি ঠিক নয় বলে নিজেই মন্তব্য করেন।
বাংলামোটরে কথা হয় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল থেকে ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় যাওয়া রোগী খালেদ মিয়ার সঙ্গে। এসময় খালেদ অভিযোগ করে বলেন, ঢাকা শহরে রাস্তায় নামলে মাঝে মাঝে মনে হয় গাড়ি চালকেরা যেন হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কোন কিছু সামনে পড়ে গেলেই কান ফাটিয়ে শব্দ করে হর্ন বাজায় তারা।
এসব বিষয়ে কথা হলে জাতীয় নাক কান গলা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মুহাম্মদ আবু হানিফ বলেন, শব্দ দূষণ শরীরের খুব মারাক্তক ক্ষতি করে। শব্দ দূষণের কারণে প্রথমে শরীরের কান এবং শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়। তাছাড়া শব্দ দূষণে বেশ কিছু রোগীর হিস্ট্রি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বর্তমানে এটির কারণে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, মানসিক অসুখের ঝুঁকি দিন দিন বেড়ে চলেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক গৌরব রঞ্জন সরকার বলেন, অতিরিক্ত শব্দ দূষণের কারণে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে যা মস্তিষ্কে আঘাত করতে পারে। দীর্ঘদিন অতিরিক্ত শব্দ শরীরকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ক্রমাগত যারা অনেক শব্দের মধ্যে থাকেন তারা ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি হাই পেশারসহ নানা ধরণের জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারেন।
কেএম/এএস