কৃষক বাঁচাতেই চালের দাম চড়া
চলতি মৌসুমে আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তারপরও কমছে না চালের দাম। কারণ কৃষকরা হাট-বাজারে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা মণ অর্থাৎ প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি ধান বিক্রি করছেন। ভোক্তাদের পকেট থেকে টাকা বেশি গেলেও দেশের কৃষকদের কিছু লাভ হচ্ছে।
প্রতি মণ ধানে ২৫ কেজি চাল হলে দাম পড়ে ৪৮ থেকে ৫৬ টাকা। এর সঙ্গে পরিবহন খরচ, আড়তদারি যোগ করলে কেজিতে আরও ২ টাকা যোগ হবে। রাজধানীতে সেই মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এ ছাড়া ২৮ চাল ৫৬ থেকে ৬০ টাকা ও মিনিকেট ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। কৃষকদের বাঁচাতে এই দাম যৌক্তিক, তা মেনে নিতে হবে। তা না হলে অর্থনীতিতে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কৃষক, সরকারি কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষেত থেকে আমন ধান উঠানো প্রায় শেষ। কৃষকের ঘরেও তেমন নেই ধান। কোনো কোনো কৃষক বাজারে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা মণ ধান বিক্রি করছেন। জানতে চাইলে নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর থানার করিমপুরের এনামুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, গুটি স্বর্ণা ধান ১২০০ টাকা মন বিক্রি হচ্ছে। যা কয়েক দিন আগে ১৪০০ টাকাও বিক্রি হয়েছে। অপরদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল থানার কাজলকেশরের সাইদুর বলেন, ‘১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা মণ ধান বিক্রি হচ্ছে। এর চেয়ে দাম কমলে লোকসান হবে। তাতে জমি চাষ করা সম্ভব হবে না। কারণ সার, শ্রমিকের দাম বেশি। ধান কাটার জন্য সহজে লোক পাওয়া যায় না।
অপরদিকে, রাজধানীতে চালের পাইকারি বাজার মোহাম্মদপুরের কৃষিমার্কেট, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন খুচরা বাজারে সরেজমিনে দেখা গেছে, মোটা চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে তা ৫৫ টাকা। দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এর মো. আব্দুল আওয়াল তালুকদার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, মোটা চাল ৫০ টাকার উপরে। এর দাম কমবে না। কারণ গ্রামেই বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ২৮ চাল ৬০ টাকা ও মিনিকেট ৭২ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। এই চালই বিভিন্ন অলিগলিতে খুচরা পর্যায়ে আরও বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে যে চালের বাজার তা থেকে দাম আর কমবে না। কারণ মোটা চাল মানুষ কম খায়। বোরা ধান মে মাসে হবে। যা থেকে ২৮ ও মিনিকেট চাল বাজারে আসে। বাজারে আসতে অনেক দেরি আছে। একই বাজারের বরিশাল রাইস এজেন্সি, কুমিল্লা রাইস এজেন্সিসহ অন্যান্য চাল ব্যবসায়ীরাও জানান, সব কিছুর দাম বাড়তি। তাই ধানের দামও বেশি। এ কারণে কমবে না চালের দাম।
এদিকে কৃষিমার্কেটের শাপলা রাইস এজেন্সিসহ অন্যান্য চাল ব্যবসায়ীরা জানান, মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা, ২৮ চাল ৫৮ থেকে ৫০ টাকা, মিনিকেট ৭০ থেকে ৭৫ টাকা, বাসমতি ৮৮, নাজিরশাইল ৮২ থেকে ৯০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। পোলাও চালের দামও বাড়তি। প্যাকেট ছাড়া এই চাল ১২৫ টাকা ও বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেট চাল ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।
এদিকে হাটে-বাজারে বেশি দাম হলেও চলতি আমন মৌসুমে সরকার ২৮ টাকা দরে ধান ও ৪২ টাকা কেজি চাল কেনার ঘোষণা দিয়েছে। গত ২ নভেম্বর খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার জানান, এবার সরকারিভাবে সারাদেশের কৃষক ও চালকল মালিকদের কাছ থেকে এই দরে তিন লাখ টন ধান ও পাঁচ লাখ টন সেদ্ধ চাল কেনা হবে।
কিন্তু তাতে উৎপাদন খরচই মিটবে না। তাই বাজারে বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে। সরকারের অন্য মন্ত্রণালয়েরও একই কথা। কম দাম হলে কৃষকরা তাদের ধান-চাল দেবে না। তা বাজারের বাস্তবভিত্তিক হতে হবে।
সার্বিক ব্যাপারে জানতে কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা না বলায় মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. বেনজীর আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এবার আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা এক কোটি ৬৩ লাখ মেট্রিক টন ধরা হলেও আশা করি উৎপাদন এক কোটি ৭৪ লাখ টন হবে। এবার কৃষক ভালোই দাম পাচ্ছেন, ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা মণ। এতে কৃষকরা খুশি। এর চেয়ে দাম কমলে তারা জমি চাষ করবে না। তাই এর চেয়ে কম দাম ঠিক হবে না। কারণ তাদের উৎপাদন খরচ এবার বেশি হয়েছে।
তাহলে খাদ্য মন্ত্রণালয় কম দামে কেনার ঘোষণা কেন দিয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে এই ডিজি বলেন, তারা কীভাবে দাম নির্ধারণ করেছে এটা তাদের ব্যাপার। কম ধরলে তাদের সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। কারণ কৃষকের লোকসান হলে জমি চাষ করবে না। তখন আমদানি করতে হবে। এরফলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এ ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. শামসুল আলম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবারে ধানের দাম বৃদ্ধি পাবে। কারণ আমনের উৎপাদনের সময় থেকেই সার, বীজ ও শ্রমিকেরও দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মূল্যস্ফীতিও প্রায় ৯ শতাংশ হয়েছে। সেটার প্রতিফলন ধান-চালেও পড়বে। কাজেই বর্তমান বাজারে ধান চালের যে মূল্য তা উৎপাদনেরই প্রতিফলন। কাজেই বর্তমানের দাম অযৌক্তিক না।
তাহলে খাদ্য মন্ত্রণালয় কেন কম দামে ধান চাল কেনার ঘোষণা দিয়েছে? এ ব্যাপারে এই কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘তারা যে সংগ্রহ মূল্য করেছে তাতে কৃষকরা ধান চাল নাও দিতে পারে। কারণ খরচ তো বেড়েছে। কাজেই তাদের সঠিক উৎপাদন খরচ ও স্বাভাবিক লভাংশ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ধরে দাম নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জমি চাষে বিমুখ হয়ে যাবে। আর চাল আমদানি করলে অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
জেডএ/আরএ/