রাজনীতিতে কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপে বিরক্ত সরকার
সম্প্রতি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের হস্তক্ষেপ প্রকাশ্যে আসে। রাজধানী ঢাকায় বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের স্থান নিয়ে সরকার ও বিএনপির নেতাদের মধ্যে তুমুল বাকযুদ্ধ এবং নয়াপল্টনে সংঘর্ষে হতাহতের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ বিদেশি কূটনীতিকরা বিবৃতি দিয়ে সরকারের সমালোচনা করেছেন।
বিদেশি দূতদের এমন আচরণে সরকার ক্ষুব্ধ। সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শুক্রবার ধানমন্ডির দলীয় কার্যালয়ে এক সভায় বিদেশি কূটনীতিকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘বন্ধুত্বটা নষ্ট করবেন না। আপনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। আমাদের অতীতের অনেক বেদনা আছে। তারপরও বন্ধুত্ব চাই। কারণ সবারই লেনদেন আছে।’
দেশের রাজনীতি নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের বিবৃতি আর সরকারি দল আওয়ামী লগের নেতাদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সরকারের সঙ্গে বিদেশি কূটনীতিকদের বিরোধের বিষয়টি।
সাবেক কূটনীতিকরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে নিরসন করলে বিদেশি কূটনীতিকরা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পেতেন না। রাজনৈতিক নেতারা বিদেশিদের কাছে ধরনা দেন বলেই কূটনীতিকরা দেশের রাজনীতিতে নাক গলান। এটা খুবই দুঃখজনক।
সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ভোটের আগের রাতে পুলিশ ব্যালট বাক্স ভরে রেখেছিল বলে তিনি ‘শুনেছেন’।
তার এমন বক্তব্য সরকার বিব্রত হয়। পরে পররাষ্ট্র সচিব জাপানি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। যদিও কূটনীতির নিয়ম অনুযায়ী তাকে তলব করা হয়নি।
তার বক্তব্যের কয়েকদিন পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশ উপনিবেশ নয়। ‘প্রয়োজনে বিদেশি দূতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার’ হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
গত ৬ ডিসেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত ১৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশন এক বিবৃতিতে ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনীয় ব্যবস্থার গুরুত্ব’ সম্পর্কে সরকারকে বুঝানোর চেষ্টা করেন। বিবৃতিতে স্পষ্ট করেই রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা বুঝিয়েছেন, বর্তমান নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয় এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে যে সিস্টেম দরকার সেই সিস্টেমের প্রবর্তন চান তারা।
১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস পালিত হয় সারাবিশ্বে। অথচ ৬ ডিসেম্বরেই ১৫ দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা মানবাধিকার দিবসের সঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচনকে সংযুক্ত করে এই বিবৃতি দেন।
বিএনপির সমাবেশ ও সমাবেশের স্থান ঘিরে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারের প্রতি ‘সভা-সমাবেশের অধিকার রক্ষার আহ্বান’ জানান । বিরোধীদের ‘ভয়ভীতি দেখানোর খবরে উদ্বেগ’ প্রকাশ করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
শুক্রবার (৯ডিসেম্বর) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এত বড় বড় কথা বলেন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত! বন্ধুত্বটা নষ্ট করবেন না। আমরা বন্ধুত্ব চাই। অতীতে ‘৭৫, ‘৭১-এর মতো অনেক বেদনা আছে। তারপরও আমরা বন্ধুত্ব চাই। এভাবে করলে বন্ধুত্বে ফাটল ধরবে। সেটায় কারও লাভ নেই।
দেশের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ ও সরকারের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা নিজেরা ঝগড়াঝাঁটি না করলেই তো আর সমস্যা হয় না। আমাদের নিজেদের মধ্যে মিল নেই বলেই কূটনীতিকরা আমাদের নিয়ে কথা বলেন। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নিজেরা কথা বলে সমস্যা মিটিয়ে ফেলা।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এ কে এম আতিকুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাদের রাজনীতিবিদরা তাদের কাছে যান বলেই তারা আমাদের ব্যাপারে কথা বলার সুযোগ পান। এটা খুবই লজ্জার। আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি ঐক্যবদ্ধ থেকে ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে আস্থা রাখতেন তাহলে এমনটা হতো না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলছেন, নানাভাবে আমরা তাদের উপর নির্ভরশীল থাকি। আমাদের ব্যাপারে নাক গলানোর এটা একটা কারণ। এ ছাড়া ভূ-রাজনীতির কিছু বিষয় থাকে।
এক প্রশ্নের জবাবে শান্তনু মজুমদার বলেন, আমাদের রাজনীতিবিদরা তাদের কাছে যান। সালিশ মানেন। তাই তারাও আমাদের ব্যাপারে নাক গলান।
এনএইচবি/আরএ/