ডোপ টেস্ট: চাকরি ফেরত পেতে মরিয়া পুলিশ সদস্যরা!
ডোপ টেস্টে পজিটিভ আসায় চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরা চাকরি ফেরত পেতে মরিয়া। ইতিমধ্যে তাদের অন্তত ৫০ জন চাকরি ফেরত পেতে আদালতে মামলা করেছেন।
অপরদিকে পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের সময় যেমন ডোপ টেস্ট করা হবে, তেমনি চাকরি চলাকালীন সময় কারও ব্যাপারে সন্দেহ জাগলে ডোপ টেস্ট করা হবে। এ ব্যাপারে পুলিশের অবস্থান পরিস্কার।
এদিকে চাকরি হারানো পুলিশ সদস্যরা বলছেন, ডোপ টেস্ট শুধু সাধারণ পুলিশ সদস্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ না করে সবার ক্ষেত্রে সকল পর্যায়ে প্রয়োগ করা উচিত। তাহলে অনেক বড় কর্মকর্তাও তাতে আটকে যাবেন। তারা বলছেন, আইন সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। না হলে আইনশৃঙ্খলা কাজে নিয়োজিত সবচেয়ে বড় বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।
ডোপ টেস্ট কাজে যুক্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ডোপ টেস্টের কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি, ফ্রেব্রুয়ারি এবং মার্চে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রায় দুই শতাধিক সদস্য চাকরি হারিয়েছেন। একইসঙ্গে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় ৬৮ জনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জানুয়ারিতে ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে চাকরি হারিয়েছেন ৩৭ পুলিশ সদস্য। ফেব্রুয়ারিতে মাদকাসক্তির কারণে চাকরি হারিয়েছে ডিএমপির ১০৬ জন পুলিশ সদস্য। এ ছাড়া, ডোপ টেস্টের ফলাফল পজেটিভ হওয়ায় এ পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় এক হাজারের মতো পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। অনেকের নামে বিভাগীয় মামলা হয়েছে, সেগুলো বিচারাধীন।
ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে চাকরি হারানো পুলিশ সদস্যরা বলছেন, যে দেশে মাদক সেবনের পারমিশন দেওয়া হয়, আবার সেই দেশে সামান্য মাদক সেবন করলে চাকরি চলে যায় আজব বিষয়। তাদের দাবি, শুধু সাধারণ পুলিশ সদস্য না, উপরের কর্মকর্তাদেরও এই টেস্টের আওতায় আনা জরুরি। অন্যথায় একই পুলিশের জন্য দুই নিয়ম হবে।
জানা যায়, ডোপ টেস্টের পজিটিভ হওয়ায় চাকরি হারানো পুলিশ সদস্যদের অনেকে চাকরি ফেরত পেতে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। মিরপুর মডেল থানায় কর্মরত অবস্থায় চাকুরি হারানো হওয়া এসআই মো. কামাল ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমাদের দেশে মদ খাওয়ার পারমিশন দেওয়া হচ্ছে। সেখানে আনন্দ করে সমান্য কিছু সেবন করলে সমস্যটা কোথায় বুঝতে পারি না! তিনি বলেন, আমি চাকরি ফেরত পেতে আদালতে মামলা করেছি। দেখা যাক মামলা কতদিন চলে এবং কি রেজাল্ট আসে।’
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ডোপ টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ আসলে সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ডোপ টেস্টে জানুয়ারিতে মোট ৩৭ জন পুলিশকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এরপরেও অনেক পুলিশের চাকরি গেছে। এটা নিয়মিত চলছে। এ কারণে পুলিশে অনেক শৃঙ্খলাও ফিরে এসেছে।
পুলিশ সদস্য ও সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তারা অস্তুষ্টি প্রকাশ করে বলছেন-শুধু পুলিশের নিচের লেভেলে নয় উপরের লেভেলেও ডোপ টেস্ট করা হোক। তাদের দাবি, পুলিশের সব পদ মর্যাদার কর্মকর্তাদের ডোপ টেস্টের আওতায় আনা উচিত। কাউকে ছোট করে দেখা ঠিক না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিভাগে কর্মরত পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘শুধু পুলিশ সদস্যদের নয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও ডোপ টেস্টের আওতায় আনা উচিত। কারণ, আমরা সবাই পুলিশের পোশাক পরা এক কাতারের মানুষ। অন্যথায় ছোট-বড় থেকে যায়।’
জানা গেছে, মেট্রোপলিটন পুলিশে ডোপ টেস্টে মোট পজিটিভ হয়েছেন তিন শতাধিকেরও বেশি। যার মধ্যে সাধারণ পুলিশ সদস্য ছাড়া ৫০ জন আছেন পুলিশের নায়েক। বাকিরা সাব-ইন্সপেক্টর। সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে ২৮ জনকে। ১৫ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। মাদকের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিযোগে ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। ১০ জন চাকরিচ্যুত বরখাস্ত করা হয়েছে।
ডোপ টেস্টে চাকরি হারানো এক পুলিশ কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, চাকরিতো হারিয়েছি, সঙ্গে একটি মামলাও হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে চাকরি ফেরতের জন্য আদালতে মামলা করেছি। আদালত যে বিচার করে সেটাই হয়তো মেনে নিতে হবে।
এসব বিষয়ে নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, ডোপ টেস্টের মাধ্যমে মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্য শনাক্ত করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে এবং এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশ সদস্যদের বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করে এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মনজুর রহমান বলেন, পুলিশ সদস্যদের ডোপ টেস্ট হলো একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। মাদকাসক্ত হিসেবে কেউ প্রমাণিত হলে প্রথমে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এবং প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, পুলিশ সদস্যের কেউ অপকর্মে জড়িত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া, যেসব পুলিশ সদস্যের ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে তাদের কেউ যদি পজেটিভ হয় তাহলে নিয়ম অনুযায়ী আমরা তাদের পুলিশ থেকে বের করে দিচ্ছি। বিভাগীয় তদন্তের পর তাদের নামে মামলাও হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে, পুলিশকে জনবান্ধব করতে পুরোনো সব ধ্যান ধারণাকে পিছনে ঠেলে আধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে-পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসুক এটা কোনো ভাবে মেনে নেওয়া হবে না। তাই সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ি পুলিশে ডোপ টেস্ট চালু করা হয়েছে। এজন্য পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে। পুলিশের যেসব সদস্য মাদকের সঙ্গে যুক্ত থাকবে তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।
এনএইচবি/এমএমএ/