আমানতের ৮.২৫ শতাংশই খেলাপি
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্তরত টোকন। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ২০০৭ সালে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেন। সংসারের খরচ মিটিয়ে প্রতি মাসে তিনি কিছু সঞ্চয়ও রাখেন। এভাবে সারা দেশের লাখ লাখ গ্রাহক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বিভিন্ন ব্যাংকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬ লাখ ২৮ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা সঞ্চয় করেছেন। সেই সঞ্চয় দিয়েই ব্যাংকগুলো ১৩ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।
এদিকে ব্যাংক মালিক থেকে শুরু করে এক শ্রেণির সুবিধাবাদী ব্যাংক কর্মকর্তাদের জোগসাজসে এসব ঋণের ৮ দশমিক ২৫ শতাংশই খেলাপি হয়েছে। অর্থাৎ মোট ঋণের খেলাপি হয়ে গেছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে আদায় অযোগ্য (ব্যাড লোন) ঋণ বা কুঋণ হচ্ছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা বা প্রায় আট শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করলেও চলে। তাই বাড়ছে খেলাপি ঋণ, কুঋণ। কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ না করলে এভাবে বাড়তেই থাকবে খেলাপি ঋণ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, জনগণ সঞ্চয়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেয়াদে ব্যাংকে (ফিক্সড ডিপোজিট) আমানত জমা রাখছেন। এই আমানত প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এক শ্রেণির গ্রাহক নিরাপদ মনে করে ব্যাংকেই বেশি করে সঞ্চয় করছেন। চলতি বছরের গত জুনে বিভিন্ন ব্যাংকে আমানত জমা হয়েছে ১৬ কোটি ২৪ লাখ ৪৭১ কোটি টাকা। এই আমানত থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়েছে ১৩ লাখ ২০ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। এভাবে তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমানত জমা হয়েছে ১৬ লাখ ২৮ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে ঋণ দেওয়া হয়েছে ১৩ লাখ ৫১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা বা মোট আমানতের ৮৩ শতাংশ।
রাষ্ট্রয়ত্ব ছয় ব্যাংকের কুঋণ ৫৬ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা
ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিলেও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা বিভিন্ন অজুহাতে ঋণ ঠিকমতো পরিশোধ করছেন না। এরফলে অবিশ্বাস্যভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে সমানতালে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি বা ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। এই খেলাপি ঋণের ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাড বা আদায় অযোগ্য বা কুঋণ হয়ে গেছে।
এরমধ্যে রাষ্ট্রয়ত্ব সোনালী, অগ্রণী, রুপালী, জনতা, বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক ও বেসিক- এই সাতটি ব্যাংকের কুঋণ হচ্ছে ৫৬ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বেসিক ব্যাংকের ৭ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা বা ৫৮ শতাংশের বেশি। সাধারণত ঋণের মেয়াদ পার হওয়ার পরও মামলা মোকদ্দমা করলেও ৫ বছরে কোনো ঋণ আদায় করতে না পারলে তা কুঋণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক হিসাব করে। এই ঋণের বেশির ভাগই আদায় অযোগ্য হয়ে যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য মতে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। খেলাপির এ অংক চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বেড়েছে ৩১ হাজার ১২২ কোটি টাকা। কারণ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর গত বছরের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জিএম আবুল কালাম আজাদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ক্লাসিফাইড (খেলাপি) ঋণ বেড়েছে, এটা সত্য। তবে খেলাপি ঋণ কমানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। কারণ জনগণের আমানত থেকেই ঋণ দেওয়া হয়। এই আমানত ভালোভাবে সংরক্ষিত থাকবে ব্যাংকে। খেলাপি ঋণ কমানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর পথে যাচ্ছে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘কোনো ব্যবসায়ীর সমস্যার কারণে হয়ত কিছুটা খেলাপি হতে পারে। কিন্তু কুঋণ লাখ কোটি টাকার উপরে। এটা খুবই ভয়াবহ চিত্র। এই ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হবে ব্যাংকগুলোকে। তাহলে কীভাবে তারা চলবে। অনেকেই ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তাদের মনে ঢুকে গেছে ব্যাংকের ঋণ নিলে ফেরত না দিলেও চলে। এই সংস্কৃতি খেলাপিদের মধ্যে ঢুকে গেছে। তাই ব্যাংক বাঁচাতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই কুঋণসহ খেলাপি ঋণ কমবে। জনগণের আমানত হেফাজতে থাকবে।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, খেলাপি ঋণ এমনিতেই ব্যাংক খাতের জন্য সমস্যা। এর ওপর দেওয়া হয়েছে ঋণ পরিশোধ না করেও নিয়মিত থাকার সুযোগ। এই ছাড়ের কারণে খেলাপিরা ভাবছে, ঋণ পরিশোধ না করলেও চলবে। আবারও অনেকে সুবিধা পেতে পেতে ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী হয়ে গেছেন। তাই যারা ঋণ পরিশোধ করছে না তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অ্যাকশনে যেতে হবে। এর সঙ্গে কোনো ব্যাংকার, পরিচালক জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক ব্যাংক প্রভিশনও রাখতে পারছে না। এরফলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ১৯ হজোর ৮৩৩ কোটি টাকা।
জেডএ/এসএন