জব্দ গাড়ি থানায় থাকে অযত্নে, গায়েব হয় মূল্যবান যন্ত্রাংশ
রাজধানী ঢাকার প্রায় প্রত্যেকটি থানা কম্পাউন্ড ও থানা সংলগ্ন এলাকায় গেলেই দেখা যায় শত শত গাড়ি, মোটরসাইকেল, রিকশাসহ বিভিন্ন রকম যানবাহনের ভাগাড়। লাখ লাখ টাকা দামের যানবাহনগুলো পড়ে আছে অযত্ন অবহেলায়। ডাম্পিং স্টেশন নামে পরিচিত ভাগাড়গুলোতে নেই কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিংবা কঠোর নজরদারি। ফলে হরদম গায়েব হচ্ছে এ সব যানবাহনের মূল্যবান যন্ত্রণাংশ।
দুর্ঘটনা, চুরি, মাদকসহ বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমায় আটক ভালো ভালো যানবাহনগুলোর স্থান হয় থানার ডাম্পিং এলাকায়। একবার থানায় ঢুকলে সেটি আর সহজে বের হতে পারে না। খোলা আকাশের নিচে দীর্ঘ সময় অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকার কারণে এক সময় দামি এ সব যানবাহন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। নষ্ট হয়। সরজমিন রাজধানীর বিভিন্ন থানা এলাকা ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
যানবাহন মালিকদের অভিযোগ, নগরীর বিভিন্ন থানায়, থানার পাশে সড়কে বছরের পর বছর গাড়ি পড়ে থাকায় শুধু নষ্ট হচ্ছে না, বিভিন্ন মামলায় জব্দ হওয়া গাড়ির মূল্যবান মালামালও চুরি হয়ে যায়।
অবশ্য পুলিশ বলছে, ডাম্পিংয়ে অনেক গাড়ি রয়েছে, যেগুলোর মামলা এখনো চলছে। তা ছাড়া বিভিন্ন মামলার আলামতের গাড়িও এ সব স্থানে রাখা হয়।
রমনা বিভাগের শাহাবাগ থানার পেছনের ডাম্পিংয়ে তিন মাস ধরে পড়ে আছে একটি মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেলের মালিক মো. মাহাবুব বলেন, ডাম্পিং থেকে মোটরসাইকেলটি আনতে গিয়ে দেখি গাড়ির হর্ন ও লুকিং গ্লাস নেই। ট্রাফিক পুলিশ মোমিনকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘আমি কিছু জানি না।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ডাম্পিং এ হাজার হাজার টাকার গাড়ি নষ্ট হচ্ছে এবং অনেক গাড়ির যন্ত্রপাতি চুরিও হচ্ছে ।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ডাম্পিংয়ে নাইনটি মডেলের একটি গাড়ি দুই মাস ধরে পড়ে ছিল। গাড়িটি বের করার পর গাড়ির মালিক শরিফুল ইসলাম বলেন, ডাম্পিং থেকে নিয়ে আসার সময় আমার গাড়ির দুইটা গ্লাসই ভাঙা পেয়েছি? ভালো গাড়ি রাখলাম আর গ্লাস ভাঙা গাড়ি বের করলাম।
রাজধানীর শেরেবাংলানগরের আগারগাঁও ও তালতলায় ডাম্পিংয়ে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, বাস, মাইক্রোবাস, পিকআপ ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা বছরের পর বছর খোলা আকাশের নিচে পড়ে রয়েছে। রোদে পুড়ছে, বৃষ্টিতে ভিজছে। চুরি হচ্ছে যন্ত্রাংশ। হারাচ্ছে ব্যবহারের উপযোগিতা। নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। একই চিত্র রাজধানীর প্রতিটি থানা ও আদালত প্রাঙ্গণে। হাজার কোটি টাকার যানবাহন অযত্ন-অবহেলায় খোলা আকাশের নিচে পড়ে রয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, ডাম্পিংয়ের ভেতরে বছরের পর বছর খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকায় যানবাহনগুলোর উপর লতাপাতা গজিয়েছে। প্রতিটি যানবাহনে মরিচা ধরেছে।
গাড়ি মালিকদের অভিযোগ, একটি গাড়ি যদি ১০-১৫ বছরে ফাঁকা জায়গায় পড়ে থাকে তাহলে সেই গাড়ির কিছুই থাকে না, এজন্য গাড়ির মালিকরা গাড়ি নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা মহানগর মালখানা পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ এ চার ভাগে বিভক্ত। জেলা মালখানা ঢাকার কালেক্টরেট ভবনের নিচতলায় এবং মহানগর মালখানা মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতের ভিতরে রয়েছে ছোট বড় অনেকগুলো যানবাহন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব যানবাহন রাখা হয়েছে আলামত হিসেবে। আলামত জমতে জমতে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে বিচারিক হাকিম আদালতের সামনের চত্বর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, লাইসেন্সবিহীন, চোরাই, দুর্ঘটনাকবলিত, মাদক বহনকারী, অবৈধ মালপত্রসহ বিভিন্ন কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেসব যানবাহন জব্দ করে, সেগুলো আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুলিশের নির্ধারিত ডাম্পিংয়ে রাখা হয়।
সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশ বলছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলা হওয়ার পর আলামত হিসেবে যানবাহন আটকে রাখা হয়। এর মধ্যে কিছু যানবাহন আদালতের নির্দেশে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপেক্ষা করতে হয় মামলা নিষ্পত্তি পর্যন্ত। আর মামলার দীর্ঘসূত্রতাই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। মামলা নিষ্পত্তি হতে ১০ থেকে ১২ বছর লেগে যায়। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আদালত হয় গাড়ি মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে বলে, না হয় নিলামে বিক্রির আদেশ দেয়। কিন্তু নিলাম প্রক্রিয়া অনেক জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। তা ছাড়া দীর্ঘদিন নিলাম না হওয়ায় এগুলো বিক্রিও করা যায় না।
পুলিশ বলছে, শুধু মোটরসাইকেল বাদে দিনে ২৫ থেকে ৩০টি গাড়ি আসে ডাম্পিং স্টেশনে। প্রচুর পরিমাণে মোটরসাইকেল রয়েছে যার হিসেব করা কঠিন। বিশেষ অভিযানের সময় ডাম্পিং স্টেশনে গাড়ি আসার পরিমাণও বেড়ে যায়। মামলার আলামতের পাশাপাশি বেওয়ারিশ গাড়িরও জায়গা হয় এখানে। দীর্ঘসময় পড়ে থাকায় একদিকে যেমন গাড়ি নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে রাস্তার ওপরে গাড়ি রাখায় ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল। তা ছাড়া ডাম্পিং স্টেশনে গাড়ি আসামাত্র অল্প টাকায় বেহাত হতে থাকে এসব গাড়ির মূল্যবান যন্ত্রাংশ। এ ছাড়া ঘন লতাগুল্মের কারণে মশা প্রজননের কেন্দ্রবিন্দুও এ সব যানবাহন। নগর পরিকল্পনাবিদদের ধারণা, এই ডাম্পিং স্টেশনগুলো এডিস মশার অভয়ারণ্য।
এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ট্রাফিক) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ডাম্পিং ব্যবস্থার বিষয়টি হলো আদালতের বিষয়। ট্রাফিক পুলিশের কাজ হলো অবৈধ গাড়ি ধরে ডাম্পিংয়ে রাখা। পরে যে সব যানবাহনের নামে মামলা হয় সেগুলোর মামলা নিষ্পতি হলে ও আদালতের অনুমতিপত্র পেলে আমরা ওই সব যানবাহন ছেড়ে দেই।
তিনি বলেন, অনেক গাড়ির মালিক মামলা নিষ্পত্তি হলেও তাদের যানবাহন নিতে আসে না। অনেক মালিককে পাওয়া যায় না। সেই ক্ষেত্রে আমরা ওই সব গাড়ির বিষয়টি আদালতে জানাই। আদালত একটি নিয়মে নিলামের জন্যে আদেশ দেন। আদালতের নির্দেশ মোতাবেক আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এরপরও এমন কিছু গাড়ি আছে যা নিলামে উঠলেও কেউ নিতে চায় না। যে কারণে ওই সব গাড়ি ডাম্পিংয়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন,যেসব গাড়ি নিলামে বিক্রি হয় সেগুলোর টাকা সরকারের রাজস্বখাতে জমা হয়।
পুলিশ সূত্র বলছে, মাদক বা চুরির মামলার কারণে যেসব গাড়ি আটক হয় এ সব গাড়ি কেউ নিতে আসে না।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদার বলেন, আমাদের থানায় বেশ কিছু যানবাহন পড়ে আছে এগুলোর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। মামলা শেষ হলে গাড়ির মালিকরা এসে গাড়ি নিয়ে যাবেন।
ডাম্পিংয়ে থেকে অনেক গাড়ি নষ্ট হচ্ছে এবং গাড়ির বিভিন্ন মালামাল চুরি হচ্ছে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, থানায় আটক হওয়া গাড়ির মালামাল চুরি হওয়ার কোনো অপশন নেই। হয়ত চোখের আড়ালে কিছু বিছিন্ন ঘটনা ঘটে।
এনএইচবি/আরএ/