প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি
অলস ৫ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা
বিদেশি ঋণের অর্থ যথাসময়ে ব্যয় করতে না পারায় সরকারকে এই ঋণের জন্য ঋণদাতাদের সার্ভিস চার্জ দিতে হচ্ছে। বর্তমানে পাইপলাইনে জমে থাকা এমন ঋণের পরিমাণ ৪৮ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। ডলারের বর্তমান বাজারমূল্য ১০৭ টাকা ধরলে বাংলাদেশি মুদ্রায় পাঁচ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি টাকা অলস পড়ে আছে।
অথচ সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বারবার বলার পরও বিদেশি ঋণের কোনো প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে ঠিকমতো ঋণও ব্যয় করা যাচ্ছে না।
ঋণের টাকায় আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার নদীবন্দর স্থাপনে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। চার বছেরে অর্থাৎ ২০২২ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিদেশি অর্থের এই প্রকল্পটির কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না। আরও দুই বছর মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। গত ১৬ আগস্ট সংশোধিত প্রস্তাবনাটি অনুমোদন দেওয়া হয়।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ১৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাস্তবে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ব্যয় করতে পেরেছে ১১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। এখনো ব্যবহার করতে পারেনি বা পাইপলাইনে আছে ৪৮ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। এসব অর্থ ব্যয় করতে না পারায় সরকারকে কমিটমেন্ট চার্জ দিতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘সরকার বললেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ঠিকমতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে না। চার থেকে পাঁচ বছরের প্রকল্পও বাস্তবায়ন করতে পারছে না। বিভিন্ন অজুহাতে সময় বাড়ায়। এতে সরকারি ব্যয় বাড়ছে। আবার জনগণ সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, গ্রেস পিরিয়ড পার হয়ে গেলে তখন অতিরিক্ত চার্জও দিতে হবে। সময় মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারায় পাইনলাইনেও বেশি করে জমে যাচ্ছে অব্যবহৃত ঋণ। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে হলে সরকারকে যেভাবে হোক প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি বাড়াতে হবে।
এ ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেছেন, বিদেশি ঋণের ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা উঠেছে। আমরা ঋণ নেব কেন? কিন্তু মনে রাখতে হবে মেট্রোরেল, ন্যাশনাল হাইওয়ে হচ্ছে বৈদেশিক ঋণে। বিদেশি সহায়তা আমাদের উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করছে। আমাদের প্রচুর ঋণ নেওয়া দরকার। কারণ বৈদেশিক ঋণে সুদ কম, পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে পরিশোধ করতে হয়। বৈদেশিক ঋণে সুদ হচ্ছে শূন্য দশমিক ৭৫ থেকে দেড় শতাংশ।
ইআরডি সূত্র আরও জানায়, গত জুন পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৫৪৩ মিলিয়ন ডলার পাইপলাইনে রয়ে গেছে। আগের অর্থবছরে পাইপলাইনে ছিলো ৫০ হাজার ৩৪৬ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে ছিল ৪৮ হাজার ৮১৯ মিলিয়ন ডলার। তার আগের অর্থবছরে ছিল ৪৪ হাজার ৫২৯ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ২০১৮ অর্থবছরে ছিল ৩৫ হাজার ৭৪৯ মিলিয়ন ডলার। এভাবে প্রতি অর্থবছরে জমে থাকছে বিদেশি ঋণ। তা ব্যবহার করতে না পারায় ঋণের সার্ভিস চার্জ ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আগের অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ১৪ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ ছিল ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, এর কারণে বাংলাদেশ শ্রীলংকা হয়ে যাবে। এটা মোটেই ঠিক না। বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। সরকার যেমন বেশি করে ঋণ নিচ্ছে তেমনি পরিশোধও করছে ভালোভাবে। বৈদেশিক ঋণ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণ করা যাবে। কিন্তু জিডিপির তুলনায় বাংলাদেশ প্রায় ১২ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নিয়েছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ উন্নয়ন সহযোগীদের এই ঋণ ২৮ বছর পর্যন্ত মেয়াদে গ্রহণ করা হচ্ছে। তারমধ্যে গড়ে গ্রেস পিরিয়ড হচ্ছে ৭ দশমিক ৬ বছর।
এসব ঋণের স্থিতি (আউটস্ট্যান্ডিং) আছে ৫৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বিশ্ব ব্যাংকের ৩২ শতাংশ। এরপর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ২৪ শতাংশ, জাপানের ১৮ শতাংশ, রাশিয়ার ৯ শতাংশ, চীনের ৮ শতাংশ, ভারতের ২ শতাংশ এবং আইডিবি ও এআইআইবির এক শতাংশ করে ঋণ রয়েছে। অন্যান্য ঋণ রয়েছে ৫ শতাংশ।
বিদেশি ঋণের শর্ত অনুযায়ী পরামর্শক নিয়োগ থেকে ঠিকাদার নিয়োগও ঋণদাতাদের ইচ্ছামতো করা হয়। তাই এই ঋণ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুললেও সরকারে পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বিদেশি ঋণের দরকার আছে। পৃথিবীর সব দেশই ঋণ নিয়ে থাকে। তাই বাংলাদেশের উন্নয়নেও এটা দরকার আছে।
এনএইচবি/এসএন