নির্বাচন ও ভাঙনের সঙ্গে জাতীয় পার্টির মধুর সম্পর্ক!
জিএম কাদের ও মশিউর রহমান রাঙ্গা
‘নির্বাচন’ আর ‘ভাঙ্গন’- এই দুই শব্দ জাতীয় পার্টির সঙ্গে যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। প্রতিবার নির্বাচন এলেই ভাঙনের বাঁশি বাজতে শুরু করে জাতীয় পার্টিতে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে জাতীয় পার্টিতে ভাঙনের তবলা ততোই জোড়ে বাজতে শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে অনৈক্য বিরাজমান। সেই অনৈক্য এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। আগামী নির্বাচনের আগে আবারও কয়েক টুকরো হতে যাচ্ছে স্বৈরাশাসক এইচ এম এরশাদের গড়া রাজনৈতিক দলটি। দলটির শীর্ষ নেতাদের মুখেই ভাঙনের শুরু প্রকাশ্যে শোনা যাচ্ছে। ফলে দলটির ভেতরে ঐক্য ধরে রাখা এখন রীতিমত চ্যালেঞ্জ।
জাতীয় পার্টির বিভেদটা প্রকাশ্যে আসে দলের উপদেষ্টা ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ সম্প্রতি দলের কাউন্সিল আহ্বান করলে। এর পর পরই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা করার জন্য স্পিকারকে চিঠি দেয় জাতীয় পার্টি। তাতে ২২ জন সংসদ সদস্য স্বাক্ষর করেন। এরমধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টির ভাঙন প্রক্রিয়া বেগবান হয়। বুধবার আগুনে ঘি ঢালেন পার্টির চেয়ারম্যান। দলটির সাবেক মহাসচিব বর্তমানে প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় প্রধান হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাকে দলের সকল পদ থেকে অব্যাহতি দেন। যার মধ্য দিয়ে দলের বিভক্তি প্রকাশ্য রূপ ধারণ করেছে। পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বুধবার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাঙ্গাকে অব্যাহতি দেন। এতে ক্ষিপ্ত মশিউর রহমান রাঙ্গা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমকে জানান, জিএম কাদেরকে রংপুরে নামতে দেওয়া হবে না। এই নিয়ে বুধবার রাতেই রংপুরে রাঙ্গা ও তাদের গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
রওশন এরশাদ ও বিদিশা এরশাদ
এদিকে রাঙ্গা অনুসারীদের অভিযোগ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান তার সিন্ডিকেটকে কাজে লাগিয়ে মশিউর রহমান রাঙ্গার বিরুদ্ধে একের পর এক তথ্য প্রচার করে যাচ্ছেন। এতেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে জাতীয় পার্টির বিভেদ।
দলটিতে আরও একটি বলয় সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদকে ঘিরে।
আরেক পক্ষে আছেন এইচ এম এরশাদের সহধর্মিনী বিদিশা এরশাদ। তিনি মাঝে মধ্যেই কথার গুলি ছুড়ছেন। নিজেকে মূল জাতীয় পার্টি দাবি করে কথা বলে যাচ্ছেন।
বিদিশা হুমকি দিয়েছেন নভেম্বর পর্যন্ত জিএম কাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। তিন মাস পরেই তিনি আর চেয়ারম্যান থাকবেন না। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের এসব বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, সামনের দিনগুলোতে জাতীয় পার্টি ভেঙে কয়েক টুকরো হতে যাচ্ছে।
বর্তমানে জাতীয় পার্টির পাঁচটি অংশ রাজনীতির মাঠে আছে। এর চারটিই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। এই চার গ্রুপের মধ্যে রয়েছে-আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি), গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) এবং প্রফেসার ডা. এম এ মুকিত এর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি। এর বাইরে প্রয়াত কাজী জাফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির বর্তমান নেতৃত্ব দিচ্ছেন মোস্তফা জামাল হায়দার।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। কিন্তু গত কয়েক বছরে দলটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়েছে। সামনে আরও ভাগ হওয়ার শঙ্কায় আছে দলটি।
জাতীয় পার্টি থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেছেন, জাতীয় পার্টি আবার ভাঙতে যাচ্ছে। তবে তিনি এই ভাঙন চান না বলেও দাবি করেছেন। নিজের রক্ত দিয়ে হলেও জাতীয় পার্টির ঐক্য চান রাঙ্গা।
মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘একটা ছোট দল আর কতবার ভাঙবে। আসলে জাতীয় পার্টিতে ভালো মানুষের অবস্থান সংকীর্ণ। অকর্মা কিছু লোকজন থাকে যাদের কাজ নাই। সারাদিন চেয়ারম্যানের কাছে ঘুর ঘুর করে। তারাই সব সময় দলটা ভাঙতে চায়। এবার ভাঙলে এই দল আর থাকবে না। আগামীতে দুটি দল ছাড়া আর কোনো দল থাকবে না। তবে সেই দুটি দলের নাম উল্লেখ করেননি।’
তবে জাতীয় পার্টিতে কোনো ভাঙন নেই বলে উল্লেখ করে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, সংগঠন বিরোধী কার্যকলাপের জন্য রাঙ্গাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এক বছর ধরেই তিনি পার্লামেন্টারি পার্টির মিটিংসহ বিভিন্ন জায়গায় সংগঠনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। রাঙ্গা দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন।
জাতীয় পার্টির শক্তি বেড়েছে দাবি করে চুন্নু বলেন, দল থেকে কেউ চলে গেলেও জাতীয় পার্টি থাকবে। দল দলের জায়গায় থাকবে। দল ভাঙবে না।
জাতীয় পার্টিতে সক্রিয় হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে এইচ এম এরশাদের দ্বিতীয় স্ত্রী বিদিশা এরশাদ দাবি করেছেন ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের নন। তিনি অবৈধ চেয়ারম্যান। আগামী ৩ মাস পর তিনি আর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান থাকবেন না।
বিদিশা এরশাদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘জিএম কাদের নিজে অবৈধ চেয়ারম্যান। তার নিজেরই বৈধতা নেই। তিনি বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতায় যেতে চান। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।’
এনএইচবি/আরএ/