সরকারি পুকুর গিলে খেলেন গোলাম মাওলা ও তার সন্তানরা!
পুকুর ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে ঘরবাড়ি
২২ শতকের সরকারি একটি আস্ত ‘পুকুর’ গিলে খেয়েছেন মো. গোলাম মাওলা (মিঞা লাল) নামে এক ব্যক্তি! ঘটনাস্থল একেবারে রাজধানীর বুকে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের ১ নং খতিয়ানভুক্ত পুকুরটির অবস্থান মোহাম্মদপুরের ওয়াশপুর মৌজার বসিলায়। এখন সেখানে পুকুরের বদলে জায়গা করে নিয়েছে পাকা দালানকোটা ও টিনশেড বাড়ি। দখলদারের ছেলেরা সেই বাড়ি থেকে ভাড়া উঠাচ্ছেন। বর্তমানে এই জমির বাজারমূল্য হচ্ছে প্রায় ১১ কোটি টাকা।
পুকুরটি উদ্ধারে কাজ করছেন পরিবেশ কর্মীরা। সরকারের ভূমি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, এটি ছিল আস্ত পুকুর এবং সরকারের সম্পত্তি। তারপরও উদ্ধার হয়নি দখলদারদের হাত থেকে।
সরেজমিন অনুসন্ধান এবং সরকারি বিভিন্ন নথি থেকে পুকুর গিলে খাওয়ার এ সব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, রাজধানীর মোহম্মদপুরের ওয়াশপুর মৌজার বসিলায় কাগজে-কলমে ২২ শতক জমির সরকারি পুকুর থাকলেও বাস্তবে এখন সেখানে পুকুরের কোনো অস্তিত্ব নেই। বরং সেখানে রয়েছে বসতবাড়ি। সরকারি পুকুর অবৈধভাবে দখল করে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। বিগত তিন বছর ধরে জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে অবগত থাকলেও পুকুর দখলমুক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পুরো পুকুরটি গিলে খেয়েছেন দখলদার মো. গোলাম মাওলা (মিঞা লাল)। সরকারি সমস্ত কাগজে জায়গাটি প্রথম শ্রেণির পুকুর হিসেবে চিহ্নিত করা রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কোনো প্রকার ইজারা বা অনুমতি ছাড়াই প্রায় আট বছর আগে পুকুরটি ভরাট করেন স্থানীয় মো. গোলাম মাওলা (মিঞা লাল) নামে এক ব্যক্তি। এই আট বছরে সে জায়গার এক অংশে দুটি পাকা দালান ও অপর অংশে বেশ কয়েকটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন গোলাম মাওলা। ২০২১ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর তার চার সন্তান সে জায়গার কর্তৃত্ব নিয়েছেন। বর্তমানে সে জায়গার দাম প্রায় ১১ কোটি টাকারও বেশি। ছেলেদের মধ্যে কবির বিভিন্ন মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন দখলকৃত জায়গাটি বৈধ করতে। কবিরের ভাই মুকুলের সঙ্গে কথা হয় ঢাকাপ্রকাশ এর এই প্রতিবেদকের।
মুকুল ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমার তিন নম্বর ভাই কবির সব জানে। কাগজপত্র সব কবিরের কাছে আছে। আমার আব্বা আমাদের দিয়ে গেছেন। মালিক আমার আব্বা। সেই ঘর তুলে দিয়েছে আমরা ভাড়া দিয়ে খাই। কাগজপত্র যা আছে সব আমার তিন নম্বর ভাইয়ের কাছে আছে। অনেক আগে পুকুর ছিল। সম্ভবত ১৯৮৬ সালে আমার আব্বা পুকুর লিজ নিয়েছিল। আব্বা মারা যাওয়ার পর আমরা আবার আবেদন করেছি। মোটামুটি কাগজপত্র ক্লিয়ার হয়ে গেছে।’
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের মন্তব্য পেতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ভাস্কর দেবনাথ বাপ্পির সঙ্গে কথা বলতে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হয়, ফোনে রিং হলেও তিনি রিসিভ না করায় কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে তার মোবাইলে এসএমএস করা হয় ‘ওয়াশপুর মৌজার আরএস ১ নং খতিয়ানভুক্ত ৫৭১ নং দাগের প্রথম শ্রেণির একটি পুকুর অবৈধভাবে দখল হয়েছে। পুকুরটি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে পেতে আপনার অফিসে একটি আবেদনও করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার একটি মন্তব্য দরকার।’ এরপরও তার কোনো সাড়া মেলেনি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় এই পুকুর ভরাট করার আগে পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের অনুমতি প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে কোনোটিই মানা হয়নি।
এবিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘অবৈধ দখলে থাকলে অবশ্যই উচ্ছেদ করতে হবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে যদি আমাদের চিঠি দেয় আমরা অবশ্যই দখলদারদের উচ্ছেদ করব।’
পরিবেশকর্মী সৈয়দ সাইফুল আলম পুকুরটি উদ্ধারে বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন। তিনি বিষয়টি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে জানিয়েছেন। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, পর্চা অনুযায়ী প্রয়াত মিঞা লালের দখলকৃত জায়গাটির প্রকৃত মালিক ঢাকা জেলা প্রশাসক। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বছিলা এলাকার ওয়াশপুর মৌজার আর এস ১ নং খতিয়ানভুক্ত ৫৭১ নং দাগের ২২ শতক জায়গাটি পুকুর শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। সেই পুকুরের চারদিকে ইটের প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে। ভেতরে একটি সেমি পাকা ঘর ও গাছগাছালিতে ভরপুর। প্রতিমাসে সেখান থেকে ভাড়া আদায় করছেন গোলাম মাওলার ছেলেরা।
ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সব নথিতেই জায়গাটি পুকুর হিসেবে চিহ্নিত। ওয়াশপুর মৌজার আর এস ১ নং খতিয়ানভুক্ত ৫৭১ নং দাগের পুকুরটি সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিয়েছেন কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আনোয়ার হোসেন।
স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, এলাকায় প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ছিলেন মিঞা লাল। একই সঙ্গে তার সন্তানরাও বর্তমানে পিতার মতো প্রভাব বিস্তার করছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও জায়গাটিতে পুকুর ছিল। প্রয়াত গোলাম মাওলা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও কেরানীগঞ্জ ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের সহায়তায় অবৈধভাবে এই পুকুর ভরাট করে নিজের দখলে নিয়েছিলেন। তবে এলাকাবাসীদের কেউই কোনো সরকারী কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করেননি।
সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, 'বর্তমানে বর্ণিত পুকুরটি উক্ত মো. গোলাম মাওলা এক অংশে একতলা পাকা দালান অপর অংশে টিনশেড ঘর নির্মাণপূর্বক তাতে ভাড়াটিয়া দ্বারা অবৈধ দখলে রেখেছেন। এমতাবস্থায় পুকুরটির দখলদার উচ্ছেদ করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।'
এ বিষয়ে সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আনোয়ার হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘সমস্ত কাগজেই জায়গাটি পুকুর হিসেবে চিহ্নিত। আমি সরজমিনে পরিদর্শন করেছি এবং সেখানে দেখেছি জনৈক গোলাম মাওলা পুকুরটি বালু দিয়ে ভরাট করে বাড়িঘর তৈরি করেছেন। আমরা দখলদার উচ্ছেদ করে পুকুরটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অনুরোধ করেছি।’
এদিকে পরিবেশ আইন অমান্য করে পুকুর ভরাট করে ঘর-বাড়ি নির্মাণের ফলে সরকারি সম্পদ বেদখল হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। স্থানীয়দের দাবি, গুরুত্বপূর্ণ এ পুকুরটি ভরাটের ফলে বর্ষা মৌসুমে আশেপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ফলে তাদের নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়। পর্চা অনুযায়ী এই পুকুরের মালিক ঢাকা জেলা প্রশাসক।
এনএইচবি/আরএ/