ত্রিরত্ন সিন্ডিকেটের কব্জায় সোহরাওয়ার্দীর কর্মচারী বদলি
দেলোয়ার-জাকির-হান্নান। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ত্রিরত্ন সিন্ডেকেট। তাদের কথা হাসপাতালের নার্স, স্টাফ-কর্মচারীদের মুখে মুখে। তাদের নির্দেশ ছাড়া হাসপাতালের কোনো কিছুই নড়চড় করে না। কাউকে অপছন্দ হলে কিংবা তাদের কথার বাইরে গেলেই বদলি করে দেন। কিংবা এমন মানসিক নির্যাতন করেন যেন ওই লোক চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। শুধু তাই নয়, তাদের নিয়ন্ত্রণে বাইরের লোকজন দিয়ে চলে হাসপাতালের ক্যানটিন। সেখান থেকে নিজেদের অংশ কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নেন।
এই দেলোয়ার-জাকির-হান্নান সিন্ডেকেটের কব্জায় হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য ‘শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড।’ গত ১১ বছর ধরে সংগঠনের ব্যবস্থাপনা কমিটির পদ আঁকড়ে আছেন দেলোয়ার।
ঢাকাপ্রকাশ-এর সরজমিন অনুসন্ধানে দেলোয়ার-জাকির-হান্নান সিন্ডিকেটের নানা কীর্তিকলাপের তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, হাসপাতালের কোন নার্স কোথায় ডিউটি করবে, কোন স্টাফ কোথায় কাজ করবে, সেটা ঠিক করে দেয় এই সিন্ডিকেট! এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেও তার কপালে নেমে আসে খড়্গ। হয় বদলি, না হয় এমন কোথাও ডিউটি দেবে যেন চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
দেলোয়ার, হান্নান ও জাকির
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের প্রতিটি কর্মচারীর মুখে মুখে এখন আলোচনা হয় দেলোয়ার-জাকির-হান্নান সিন্ডিকেটের কথা। এদের মধ্যে দেলোয়ার হোসেন এখন স্টোর কিপার। ব্রাদার জাকির নামে পরিচিত যিনি তিনি হলেন ওয়ার্ড মাস্টার জাকির হোসেন উকিল। অন্যজন হলেন সিনিয়র স্টাফ নার্স আব্দুল হান্নান মুন্সি।
হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সংগঠন ‘শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড’। কিন্তু এই সংগঠনের ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও গত ১১ বছরে নির্বাচন বা নতুন কমিটি গঠন হয়নি। জানা গেছে, ব্যবস্থাপনা কমিটি তাদের মেয়াদকালের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা কমিটি পুনর্গঠনে সক্ষম না হওয়ায় সমবায় সমিতি আইন ২০০১ (সংশোধন-২০০২) এর ১৭ (৭) ধারা মতে সমিতির জন্য অন্তর্বতী ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয় ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর। এই কমিটি দায়িত্ব ছিল ৯০ দিনের মধ্যে নতুন কমিটি গঠন করার। কিন্তু সেই ৯০ দিন ১১ বছরেও শেষ হয়নি। নির্বাচন বা নতুন কমিটি দূরের কথা, সেটি না করে এখনো পদ আঁকড়ে আছেন দেলোয়ার হোসেন। তিনি এই কমিটির সভাপতি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে একটি ক্যানটিন করা হয়েছিল হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কল্যাণে। ওই ক্যানটিনের শেয়ার ছাড়া হয়েছিল। অনেক কর্মচারী ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে দুই হাজার টাকার শেয়ার কিনেছিলেন। বাৎসরিক হিসেবে সেই শেয়ারের লভ্যাংশ যেত কর্মচারীদের কাছে। কিন্তু দেলোয়ার-জাকির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সেই টাকা আর পান না কর্মচারীরা। টাকা কোথায় যায় সেটাও কেউ বলতে পারেন না। এনিয়ে কর্মচারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
হাসপাতালের একাধিক স্টাফের সঙ্গে কথা বললে তারা তাদের ক্ষোভের কথা জানান ঢাকাপ্রকাশ-কে। কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে এবং দেলোয়ার-জাকিরের ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান না।
তবে মুজিবুর নামে এক কর্মচারী বলেন, আমি এক হাজার টাকার শেয়ার কিনেছিলাম। সব লুটপাট করে খাচ্ছে দেলোয়ার আর জাকির। আমাদের গরিবের হক, সেই টাকাও মেরে দিচ্ছে তারা। ২০০৬ সাল থেকে এই ক্যানটিনের ভাড়া দেয় না। কে চালায় তাও কেউ বলতে পারে না।
সম্প্রতি শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ঘুরে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাবুল নামে বহিরাগত এক ব্যক্তি ক্যান্টিন নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি কার কাছ থেকে কীভাবে, কত টাকায় ক্যানটিন ভাড়া নিয়েছেন? কিংবা টাকা কাকে দেন, সেটাও পরিষ্কার করে কেউ বলতে পারেননি।
অবশ্য ক্যানটিনের ম্যানেজার আব্দুল্লাহ জানান, কারে, কে কত টাকা ভাড়া দেয় সেটা হাবুল ভাই বলতে পারবেন। এই হাবুল ভাই কে? হাসাপাতালের কেউ বলতে পারেননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বাইরের একজন দেলোয়ারকে ম্যানেজ করে এই ব্যবসা করছেন।
হাসপাতালের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যানটিনটি চলত মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাড়ায়। এই ভাড়া থেকে যে আয় হতো তা শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে আনুপাতিক হারে ভাগ করে দেওয়া হতো। নিজেদের ন্যায্য পাওনার বিষয়ে কথা বলতে যাওয়ায় একজন সিনিয়র নার্সকে মাদারীপুরে বদলি করে দেন দেলোয়ার হোসেন।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে সেই নার্স বলেন, ওই হাসপাতালে ন্যায্য কথা বলা যায় না। যেই কথা বলবে তাকেই শাস্তি ভোগ করতে হবে। আসলে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে দেলোয়ার-জাকির-হান্নান সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না।
অবশ্যই এ সব অভিযোগ অস্বীকার করেন দেলোয়ার হোসেন। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘অভিযোগ আমার নামে হতেই পারে। চাকরি করি ৯-১০ বছর ধরে। সবার মন তো রক্ষা করা যায় না। তবে অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখেন সঠিক কি-না? আমার প্রতিপক্ষ বলতেই পারে। আমার নামে এই আছে সেই আছে। যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে এগুলো সত্য না।
একই কথা বলেছেন সিনিয়র স্টাফ নার্স আব্দুল হান্নান মুন্সি। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ওই ক্যান্টিন আমাদের ছিল। কিন্তু অনেক দিন সেটার কোনো কার্যক্রম নেই। কে টাকা তোলে সেটা আমি জানি না। দেলোয়ার সাহেব যেহেতু সভাপতি তিনিই জানেন।
তবে ক্যানটিন নিয়ে এত কিছু ঘটে গেলেও সে বিষয়ে জানেন না হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ক্যানটিন কে চালায় সেটা জানতাম না। আমি সম্প্রতি অভিযানে গিয়েছি। তাদের বলেছি, কে চালায় আমাকে জানাতে হবে। এখন যেই চালাক টেন্ডারে আসতে হবে। যিনি টেন্ডারে পাবেন তিনিই চালাবেন। বাইরের কেউ এখানে এসে খাওয়ার সুযোগ নেই।
এনএইচবি/আরএ/