ঢামেক চিকিৎসক পিযূষের বিরুদ্ধে অর্ধশত অভিযোগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগটি এখন রোগীদের জন্য আতঙ্কের বিভাগের পরিণত হয়েছে। এই বিভাগের ভর্তি করা রোগীরা সব সময় ডাক্তারদের নিয়ে আতঙ্কে থাকেন! নিউরোসার্জারি ইয়েলো ইউনিটের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. পীযূষ কান্তি মিত্রের বিরুদ্ধে গত এক বছরে লিখিত ও মৌখিকভাবে অর্ধশত অভিযোগ করেন রোগী ও তার স্বজনরা। এর কোনো প্রতিকার এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে নিতে পারেনি।
শুধু রোগী নয় হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া নতুন করে আবার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর ঘাড়ে স্ত্রু না লাগিয়েও ৩৫ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ করেছেন রোগীর লোকজন। তার ইউনিটে রোগী ভর্তি হলেই তিনি অস্ত্রোপচার বা আইসিইউ নিয়ে ব্যবসা শুরু করে দেন বলে অভিযোগ। এত অভিযোগের পরও তার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী রোগী মো. দেলোয়ার হোসেনের ছেলে শেখ আজিজুল হাকিম গত ৪ সেপ্টেম্বর ঢামেক হাসপাতালের পরিচালকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করেছেন।
আজিজুল হাকিম লিখিত অভিযোগে বলেন, ‘আমার বাবা দেলোয়ার হোসেন, বয়স ৫৫ বছর। আমার বাবা অত্র হাসপাতালে চলতি বছরের জুলাই মাসের ৭ তারিখ থেকে চিকিৎসাধীন। পরে আগস্ট মাসের ৩ তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত নিউরোসার্জারি বিভাগের ইয়েলো ইউনিটের কেবিন নম্বর ৬৬ (এ) তে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। আমার বাবার ঘাড়ের অপারেশনের জন্য স্ক্রু লাগবে বলে আমাকে জানানো হয় ৩৫ হাজার টাকা লাগবে। গত আগস্ট মাসের ১৭ তারিখে অপারেশনের পরে আমার কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা নেন। এবং মনির সার্জিক্যালের একটি মানি রিসিট দেওয়া হয়। পরে এক্সরে করে দেখা যায় ঘাড়ে কোনো স্ক্রু লাগানো হয়নি। এ অবস্থায় আমার আকুল আবেদন এই যে, আমার বাবার ঘাড়ে স্ক্রু না লাগিয়েও যে টাকা নেওয়া হয়েছে, আমি এই দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত করে সঠিক বিচার চাই।’
চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী শেখ আজিজুল হাকিম বলেন, ‘আমার বাবার ঘাড়ের অপারেশনে স্ক্রু লাগানোর কথা বলে ডা. পীযূষ কান্তি মিত্র অপারেশন শেষে ৩৫ হাজার টাকা ম্যানেজ আছে কি না জানতে চান। টাকা ম্যানেজ করে রেখেছি বলে তাকে জানাই। এরপর তিনি একটি ছেলের কাছে ৩৫ হাজার টাকা দিতে বলেন। আমি ওই ছেলের কাছে টাকা দিলে তিনি আমাকে টাকা গ্রহণ করার একটি মানি রিসিট (দোকানের নাম মনির সার্জিক্যাল) দেন। কিন্তু পরে বাবার ঘাড়ে এক্সরে করে দেখি সেখানে কোনো স্ক্রু লাগানো হয়নি। এ ঘটনায় আমি হাসপাতালের পরিচালক ও কলেজের অধ্যক্ষের কাছে একটি অভিযোগ দিয়েছি। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় তিনি আমাকে আগামী শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন।
এবিষয়ে জানতে চাইলে মনির সার্জিক্যালের সোহেল বলেন, ‘অপারেশনের পর পীযূষ কান্তি স্যার আমাকে ৩৫ হাজার টাকার একটি মানি রিসিট দিয়ে রোগীর ছেলের কাছ থেকে টাকা নিতে বলেন। তার কথা অনুযায়ী আমি ওই রোগীর ছেলের কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে তাকে একটি মানি রিসিট দেই। এরপর মেশিনের ভাড়া বাবদ ৬ হাজার টাকা রেখে ২৯ হাজার টাকা স্যারের কাছে দেই। পীযূষ স্যার বলেন আমি রোগীর ছেলেকে ২৯ হাজার টাকা ফেরত দিয়ে দেব। কিন্তু তিনি ওই রোগীর ছেলেকে টাকা ফেরত দিয়েছেন কি না সে বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে সেখানে যে স্ক্রু লাগানোর কথা ছিল সেটি স্যার লাগাননি।’
তবে অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করে অধ্যাপক ডা. পীযূষ কান্তি মিত্র বলেন, ‘টাকা নেওয়ার বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার বিরুদ্ধে একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে। রোগীর ছেলে যে অভিযোগটি করেছেন সেই অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট।’
ভুক্তভোগীর ছেলে আপনার কথায় মনির সার্জিক্যালের এক ছেলেকে টাকা দিয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি টাকা নেইনি।’ ভুক্তভোগী আপনার বিরুদ্ধে ভিডিও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি সংবাদ প্রচার না করার জন্য বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢামেক হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের কয়েকজন চিকিৎসক বলেন, উনার (ডা. পীযূষ কান্তি) বিরুদ্ধে গত এক বছরে প্রায় অর্ধশত লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ হাসপাতালের পরিচালকের কাছে রোগীর লোকজন দিয়েছে। কিন্তু উনার কোনো বিচার হয় না। এই বিভাগে আমরা চাকরি করি আমাদের মানসম্মান নিয়ে উনি টানাহ্যাঁচড়া করছেন। আমরা তার বিচার চাই। তাকে এখান থেকে বদলি করা হোক। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো শতভাগ সত্য। এত ঘটনার পরও তিনি এক বিশেষ ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ হওয়ায় একটি ইউনিটের প্রধান হয়ে গেলেন। যে কারণে তিনি কাউকেই তোয়াক্কা করেন না। উনার বিরুদ্ধে দুদকে এখনো মামলা চলছে। ওনার কারণে নিউরোসার্জারি বিভাগের অন্যান্য চিকিৎসক এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
তারা আরও বলেন, স্ক্রু না লাগিয়ে রোগীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া একটি গুরুতর অপরাধ। ঢাকা মেডিকেলে বেশিরভাগ রোগী বিভিন্ন গ্রাম এলাকা থেকে আসেন। অসহায় এই মানুষকে জিম্মি করে তিনি টাকা আদায় করেন। তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নিউরোসার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. অসিত চন্দ্র সরকার বলেন, ‘আমরা তাকে নিয়ে খুবই বিব্রত ও অস্বস্তিতে আছি। তিনি একের পর এক অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন। কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কারণে এত অপকর্মের পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তবে প্রশাসনিক ব্লক থেকে আমার কাছে এখন পর্যন্ত কোনো কাগজ আসেনি।’
তিনি আরও বলেন, শুনেছি ডা. পীযূষ কান্তি যে অপারেশনের জন্য ৩৫ হাজার টাকা নিয়েছেন, সেটা অনেক বেশি। এ ছাড়া তার যদি কোনো অসৎ উদ্দেশ্য না থাকে তাহলে স্ক্রু না লাগালে রোগী ভর্তি থাকা অবস্থায় তার টাকা ফেরত দেওয়ার কথা। কিন্তু রোগী ছাড়পত্র নিয়ে অনেক আগেই চলে গেছে, টাকা তিনি ফেরত দেননি। তার মানে তিনি এই টাকা রোগীর কাছ থেকে অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন।’
কার ছত্রছায়ায় তিনি এই ধরনের অপকর্ম করছেন সেটি খুঁজে বের করার কথা উল্লেখ করে বিভাগীয় প্রধান আরও বলেন, ‘আমার ক্ষেত্রে যদি এমন হতো তাহলে আমি নিজেই এখান থেকে চলে যেতাম। ঢাকা মেডিকেলের মতো জায়গায় তার মতো চিকিৎসকের দরকার নেই বলে আমি মনে করি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, ‘আমরা ডা. পীযূষ কান্তি মিত্রের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি যাচাই-বাছাই করছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজন ব্যবস্হা নেওয়া হবে। তাকে আর ছাড় দেওয়ায় হবে না। বার বার তার বিরুদ্ধে একটা না একটা অভিযোগ আছেই।’
এসএন