২০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত প্রকল্পে অযৌক্তিক ব্যয়!
ইস্টার্ন রিফাইনারি
মাত্র ১৮৪ জনের বিদেশ প্রশিক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় আট কোটি টাকা! মিটিং খাতে ব্যয়ের প্রস্তাব রাখা হয়েছে সাড়ে চার কোটি টাকা! আপ্যায়ন, প্রচার বিজ্ঞাপনেও ব্যয় করা হবে চার কোটি টাকা। বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিভিন্ন ভবনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কিনতে ১৩৫ কোটি টাকা।
এ রকম আরও অনেকগুলো খাত আছে। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ‘ইন্সটলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২’ শীর্ষক এই প্রকল্পের প্রস্তাব নিয়ে ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের বেশ কিছু বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে চেয়েছে।
অবশ্য বিশ্ব তথা দেশের অর্থনীতির এই কঠিন সংকটময় সময়ে সরকারের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এরকম একটি বৃহৎ প্রকল্পের যৌক্তিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। যেখানে সরকার সবকিছুতে ব্যয় সংকোচন নীতি নিয়েছে সেখানে এরকম একটি প্রকল্পের চাপ কতোটা সামলাতে পারবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জানা গেছে, অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ‘ইন্সটলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২’ শীর্ষক প্রকল্পে (২০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প) অনেকগুলো খাতে অযৌক্তিক ব্যয় ধরা হয়েছে। বিশাল অংকের এই প্রকল্পে কোনো বিদেশি ঋণ না পাওয়ায় সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে বাস্তবায়ন করার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) পক্ষে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও আগে তা করা হয়নি। বরং আমদানির নামে হরিলুট হয়েছে। আবার দেরিতে হলেও প্রস্তাবিত প্রকল্পটি গ্রহণ করতে গিয়ে সূক্ষ্মভাবে প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে বেশি বেশি ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি মূলত সরকারি অর্থ লোটপাটের একটা প্রক্রিয়া।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম প্রস্তাবিত এই প্রকল্প সম্পর্কে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, দেশের ভোক্তার জন্য যখন যা দরকার তা করা হয় না। পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। এই ব্যয়ের নামে সরকারি অর্থ লুণ্ঠন করা হচ্ছে। সময়ের কাজ সময়ে করা হয় না। অসময়েও যা করা হচ্ছে সেখানেও অর্থ লুটের পাঁয়তারা শুরু হয়ে গেছে। বর্তমানে দেশে যে সংকট তাতে এতো অর্থ ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইআরএল। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তারা এ কাজ করার চেষ্টা করছে। এটা পরিকল্পনা কমিশনকে শক্ত হাতে ধরা দরকার। কারণ কোনো ফাঁকফোকর পেলে তারা হাতিয়ে নেবে দেশের অর্থ।’
প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. লোকমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন,‘ব্যবস্থাপনাগতভাবে কিছু সমস্যা থাকায় আগে প্রকল্পটি তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আমি ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এমডি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই ইআরএল এর বার্ষিক (ক্রুড প্রসেসিং) উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছি। এ জন্য দীর্ঘদিন আলাপ আলোচনা করে ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডিয়া লিমিটেডসহ দুই প্রতিষ্ঠানকে কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা সমীক্ষা) করা হয়েছে। তার ভিত্তিতেই এই প্রকল্পটি তৈরি করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। দেশি অর্থে এটা করা হবে। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর প্রায় যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। ২৪ আগস্ট এর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি টেকনিক্যাল প্রকল্প। তাই বিদেশ থেকে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। ডিপিপিতে প্রথমে ৩৮৯ জন ধরা হলেও কাটছাঁট করে ১৮৪ জনকে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য রাখা হয়েছে। পিইসি সভায় কিছু ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশন সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে চেয়েছে। এটা স্পষ্ট করা হবে, রিভিউ হবে। সংশোধন করে আবার পরিকল্পনা কমিশনে পাঠনো হবে।’
ঠিকাদারের সঙ্গে মিটিংয়ের ব্যয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে ঠিক না। বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন লোকের সঙ্গে মিটিং করতে হবে। তাতে তো খরচ হবে।’
কঠিন সময়ে দেশিয় অর্থে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী মনে করলে এর অনুমোদন দেবেন। না দিলে হবে না। আমরা আমাদের দিক থেকে সব প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত জ্বালানি তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে ইআরএল এর বার্ষিক (ক্রুড প্রসেসিং) উৎপাদন ক্ষমতা দেড় মিলিয়ন (১৫ লাখ) মেট্রিক টন। এই রিফাইনারিটি ৫০ বছরের পুরাতন। কিন্তু বর্তমানে দেশের পেট্রোলিয়াম পণ্যের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। তাই পরিশোধন ক্ষমতা বৃদ্ধি ও আমদানি নির্ভরতা কমাতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে একটি প্রকল্প তৈরি করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটির পতেঙ্গায় ইআরএলের খালি ৫৯ একর জায়গা ও লিজকৃত ৬৪ একর জমিতে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। তাতে বছরে তিন মিলিয়ন মেট্রিক টন ক্ষমতা সম্পন্ন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপন করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ইআরএল-এর বার্ষিক ক্রুড প্রসেসিং ক্ষমতা সাড়ে ৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন হবে। দেশের জ্বালানি খাতে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ভারসাম্য আসবে। পরিবেশবান্ধব গ্যাসোলিন ও ডিজেল জ্বালানি উৎপাদন সম্ভব হবে।
এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে পাঁচ বছর। অর্থাৎ ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত।
প্রস্তাবিত এই প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে প্রায় আট কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এই ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে এনে তা কমাতে হবে বলে সভায় পিআইসি জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, প্রকল্পের কেমিক্যাল, লুব্রিকেন্টে ২০২ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। কনস্ট্রাকশন সুপারভিশনেও ৪৯০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া মোটরযান মেরামতে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় অত্যধিক প্রতীয়মান হওয়ায় তা যৌক্তিক পর্যায়ে কমাতে বলা হয়েছে। প্রশাসনিক ও আবাসিক ভবনে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, টেলিযোগাযোগ খাতে দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। যা অত্যধিক। প্রশাসিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণেও অত্যধিক ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। তাই এই ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে পুনঃনির্ধারণ করতে পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে।
প্রকল্প প্রস্তাবনায় ১২৩ একর জমিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা উল্লেখ হলেও মৌজা, দাগ, খতিয়ান নম্বর উল্লেখ করা হয়নি। আসলে কী পরিমাণ জমি লাগবে, এই বিষয়টিও স্পষ্ট করতে বলা হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, প্রকল্পের প্রধান প্রধান কাজ ধরা হয়েছে সাইট প্রিপারেশন, ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট, কনস্ট্রাকশন (সিভিল ও মেকানিক্যাল) কাজ, পিডিবি থেকে ইলেকট্রিক্যাল লাইন স্থাপন এবং ন্যাচারাল গ্যাস সংযোগ স্থাপন।
এনএইচবি/আরএ/