জাতীয় পার্টি কি বিএনপির দিকে ঝুঁকছে?
ক্ষমতায় যেতে অস্থির হয়ে উঠেছে জাতীয় পার্টি। পার্টির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের ইতোমধ্যে বিএনপির সঙ্গে দরকষাকষি করছেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে জাতীয় পার্টির।
এটা আরও পরিস্কার হয়ে উঠে সম্প্রতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা বানানোর জন্য স্পিকারকে চিঠি দেওয়ার পর।
এ নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের মধ্যে মতো পার্থক্য দেখা দিয়েছে।
জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দল গত ১ সেপ্টেম্বর একটি চিঠি দেয়। সেই চিঠিতে বেগম রওশন এরশাদকে বিরোধী দলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান কাদেরকে বসানোর জন্য অনুরোধ করা হয়। আগে থেকেই রওশন ও কাদেরের মধ্যে মতবিরোধ চলছিল। স্পিকারকে দেওয়া চিঠি সেই বিরোধে ঘি ঢেলেছে।
জিএম কাদের বর্তমানে সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করছেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য জাতীয় সংসদের গত কয়েকটি অধিবেশনে অনুপস্থিত ছিলেন রওশন এরশাদ। তাই অধিবেশনে সমাপনী ভাষণে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে উপনেতা জিএম কাদেরই প্রতিনিধিত্ব করেন।
বিরোধী দলীয় নেতার এই অসুস্থতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য সফল করতে মরিয়া জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের নেতারা। স্পিকারকে দেওয়া চিঠিতে ২৬ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ২২ জন স্বাক্ষর করেছেন। যারা জিএম কাদেরকে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দেখতে চান।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টি যখন সুসংগঠিত করার ডাক দিয়েছেন দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক তখনই বেঁকে বসেছেন জিএম কাদেরপন্থী সংসদ সদস্যরা। রওশন এরশাদ আগামী ২৬ নভেম্বর জাতীয় পার্টির কাউন্সিলের ডাক দিয়েছেন। সেই কাউন্সিলের মূল উদ্দেশ্য ছিল আগামী নির্বাচন জাতীয় পার্টি এককভাবে করবে নাকি কোনো জোটে যাবে-সেসব বিষয়ে আলোচনা করা ও কাউন্সিল থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া।
জাতীয় পার্টি সূত্রে জানা গেছে, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বরাবরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি অনুগত। তাই যত কিছুই হোক তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে যেতে নারাজ। বরং সংসদ সদস্যদের নিয়ে কীভাবে দরকষাকষি করা যায় সেই পরিকল্পনা করতেই কাউন্সিল করতে চেয়েছিলে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের কিছুদিন আগে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। তার সেই সফরকে ঘিরে কানাঘুষা শুরু হয়েছে দলের ভেতর। দলের অনেক নেতাই মনে করেন তিনি চিকিৎসার জন্য নয়, বিশেষ কোনো কারণে বিদেশে যান। সেখানে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে তার একটি বৈঠকও হয়।
যদিও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সম্প্রতি ঢাকাপ্রকাশ-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি পার্টির মহাসচিব, আমাদের পার্টির চেয়ারম্যান বিদেশে গিয়ে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করলে আমি জানব না?
তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে জাতীয় পার্টির কোনোদিনই মিত্রতা হবে না। বিএনপি জাতীয় পার্টিকে যত নির্যাতন করেছে তাদের সঙ্গে কখনো মিত্রতা হবে না।
এ বিষয়ে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘ম্যাডাম তো দলের ঐক্য ধরে রাখতেই কাউন্সিলের ডাক দিয়েছিলেন। এখন তো দেখছি তারা কাউন্সিলেই যেত চাচ্ছে না।’
রওশন এরশাদকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে বিরোধী দলীয় নেতা করতে যারা স্বাক্ষর করেছে তারাই বলতে পারবেন কেন তারা স্বাক্ষর দিয়েছেন। বিষয়টা নিয়ে আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষকও কনফিউসড, আমরাও কনফিউসড।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা আছে তাদের নিয়েই তো কাউন্সিল করতে চেয়েছেন। খেলার কী আছে, আমি শুধু প্রধান পৃষ্ঠপোষকের চিঠি প্রকাশ করেছি। এখানে খেলার কিছু নেই।
তিনি বলেন, আপনি যদি ঘরে বসে বলেন বিএনপির দিকে গেলাম, আমি ঘরে বসে যদি বলি আওয়ামী লীগের দিকে গেলাম সেটা তো ঠিক না। সেটা পরিস্কার করার জন্যই প্রধান পৃষ্ঠপোষক কাউন্সিল ডেকেছেন। আগামী নির্বাচনে কী করা উচিত, জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হবে? নির্বাচনে আমরা এককভাবে অংশ নেব কি না এসব বিষয়ে আলোচনা করতেই কাউন্সিল ডাকা হয়েছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান কি তাহলে বিএনপির দিকে হাঁটছেন এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম মসীহ বলেন, ‘আমরাও দেখছি, তাদের স্টেটমেন্ট সব বিএনপি লাইনের স্টেটমেন্ট। তবে যাই করুক সেটার জন্যও তো সবার সঙ্গে আলাপ না করে হঠাৎ বললাম আমি বিএনপির দিকে গেলাম এটা তো হয় না। এজন্য তো দলের ম্যানডেট নিতে হয়। এটা তো কাউন্সিলে ঠিক হবে। তাদের (জিএম কাদের) স্টেটমেন্টগুলো তো তাদের লাইনেরই স্টেটমেন্ট।’
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে বিরোধী দলীয় নেতা করতে স্পিকারকে চিঠি দিয়েছে সেই চিঠিতে আপনাদের ২৬ জন সংসদ সদস্যের ২২ জনই স্বাক্ষর করেছেন। তার মানে বিরোধী দলীয় নেতা কি একা হয়ে গেলেন?
জবাবে মসীহ বলেন, পার্টি যদি থাকে তাতে তো সমস্যা হওয়ার কথা না। আমার বিশ্বাস পার্টি ম্যাডামের সঙ্গেই থাকবে। যেসব সংসদ সদস্যের কথা বলছেন তাদেরকে তো ম্যাডামই সংসদ সদস্য করেছেন। তারা আজকে আছে, দেখবেন অনেক সংসদ সদস্য গত সংসদে ছিলেন, এবার নাই।
গত ১৯ আগস্ট নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর ছেলে আবরার ইলিয়াসের বিয়ের অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের একই টেবিলে বসে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেন। এখান থেকে গুঞ্জনের সূত্রপাত।
এ ছাড়া কিছুদিন আগে জিএম কাদের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান। ঠিক একই সময়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য মির্জা আব্বাসসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা সিঙ্গাপুরে অবস্থান করেন। দেশে ফেরার পথে জিএম কাদের ও মির্জা আব্বাস একই ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন। একই সময়ে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সিঙ্গাপুর সফর রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
জাতীয় পার্টি ও রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোচনা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বিএনপির সঙ্গে মিলে সরকার হটাতে চান। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চান বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
এদিকে এইচ এম এরশাদের দ্বিতীয় স্ত্রী বিদিশা এরশাদ দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি দাবি করেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের নন। তিনি অবৈধ চেয়ারম্যান। আগামী ৩ মাস পর তিনি আর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান থাকবেন না।
বিদিশা এরশাদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘জিএম কাদের, তিনি নিজে অবৈধ চেয়ারম্যান। তার নিজেরই বৈধতা নেই। তিনি বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতায় যেতে চান। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।’
তা ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সরকারের কঠোর সমালোচনা করছেন এবং আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত জাতীয় পার্টি।
কিছুদিন আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের সরকারের সমালোচনা করে বলেন, ‘সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়েই শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে গেছে। ঋণ নির্ভরতার কারণে দেশের ব্যাংকে টাকা নেই। পরিচালন ব্যয় না কমালে ব্যাংক থেকে ঋণ করে বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হবে। এ কারণেই দেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে।’
এনএইচবি/এমএমএ/