জিরো টলারেন্সেও থামছে না ইয়াবার থাবা
ইয়াবার ভয়ংকর থাবা ক্রমেই গ্রাস করছে দেশের তরুণ ও যুবসমাজকে। উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরাই এর বড় শিকার। একসময় গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার মাদকাসক্তদের কাছে ইয়াবার পরিচিতি ছিল দামি মাদক হিসেবে। কিন্তু বর্তমানে রাজধানীর পাড়া-মহল্লা, অলিগলি থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রামাঞ্চলেও হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে ইয়াবা।
অথচ সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানরা বারবার মাদকের বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’র (শূন্য সহনশীলতা) কথা বললেও এখন পর্যন্ত মাদক ব্যবসা বিশেষ করে ইয়াবা ব্যবসার পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করলেও তেমন কোনো ফল আসেনি। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মাদক ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তারা খুবই ক্ষমতাধর ব্যক্তি। কেউ রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী, কেউ প্রশাসনিকভাবে শক্তিশালী, কেউবা টাকায় শক্তিশালী। অভিযোগ আছে, কোথাও কোথাও প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও নানাভাবে মাদকের সঙ্গে জড়িত আছেন। এসব কারণে মাদকের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো অভিযান দেখা যায় না।
অবশ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা সমাজের কেউকেটা হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে তেমন কিছু করা যায় না।
ইয়াবা যেভাবে জীবনশক্তি শেষ করছে
প্রথম প্রথম ইয়াবা সেবনের কারণে একজন শান্ত মানুষ হিংস্র হয়ে উঠে। আর দীর্ঘদিন সেবনের ফলে তার জীবনীশক্তি ক্ষয় হতে থাকে। শরীরে ঝিমুনি আসে। কর্মক্ষমতা হারায়। যৌন সক্ষমতা হারিয়ে যায়। দাম্পত্য জীবনে অশান্তি। বিচ্ছেদ ঘটে। দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ইয়াবা সেবনকারীদের নার্ভ বা স্নায়ুগুলো অচল হয়ে যায়। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, দেশজুড়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের বিশাল সার্কেল গড়ে উঠছে। ইয়াবার এই ভয়ংকর থাবায় নতুন নতুন মুখ আসক্ত হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে অসংখ্য পরিবার।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা নিয়মিত ইয়াবা সেবন করে তাদের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, নিদ্রাহীনতা, খিঁচুনি, মস্তিষ্ক বিকৃতি, রক্তচাপ বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন, হার্ট অ্যাটাক, ঘুমের ব্যাঘাত, শরীরে কিছু চলাফেরার অস্তিত্ব টের পাওয়া, অস্বস্তিকর মানসিক অবস্থা, কিডনি বিকল, চিরস্থায়ী যৌন-অক্ষমতা, ফুসফুসের প্রদাহসহ ফুসফুসে টিউমার ও ক্যান্সার হতে পারে।
একাধিক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ইয়াবাসেবনকারীর সংখ্যা ৮০ লাখেরও বেশি। সম্প্রতি প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা সাময়িকীর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মাদকাসক্তদের ৫৮ শতাংশেরও বেশি ইয়াবাসেবী।
গবেষকরা বলছেন, ২০০০ সালের পর থেকে দেশের অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা ইয়াবার প্রতি আসক্ত হতে থাকে। ওই সময়ে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে এই ট্যাবলেট আসতে শুরু করে। তারপর ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে। একসময় খুব দ্রুততার সঙ্গে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
এখন দেশের অভিজাত এলাকা থেকে বস্তি, গ্রামগঞ্জ সর্বত্রই ইয়াবার বিস্তার ঘটেছে। বিশেষ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই মাদক সেবনের প্রবণতা বেশি। এ ছাড়া বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, শিল্পী, মডেল, অভিনেতা, শিক্ষক-শিক্ষিকারাও জড়িয়ে গেছেন এই মরণ নেশায়।
যেভাবে প্রবেশ করছে ইয়াবা
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে থেকে জানা যায়, ইয়াবার সবচেয়ে বড় রুট হচ্ছে টেকনাফ সীমান্ত। এর বাইরে সমুদ্রপথে ইয়াবা ঢুকছে চট্টগ্রাম দিয়েও। ইয়াবা ছাড়া অন্যান্য মাদক ঢুকছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত দিয়েও। বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, তাকি, বশিরহাট, স্বরূপনগর, বাদুরিয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বনগাঁও, পেট্রাপোল, হেলেঞ্চা, ভবানীপুর, রানাঘাট, অমৃতবাজার, বিরামপুর, করিমপুর, নদীয়া, মালদাহ, বালুরঘাট, আওরঙ্গবাদ, নিমতিতাসহ সীমান্ত সংলগ্ন প্রায় সব এলাকা থেকে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট এবং দিনাজপুর সীমান্ত দিয়ে মাদক ঢুকছে৷ ভারতের আসাম এবং মেঘালয়ের বাংলাদেশ ঘেঁষা এলাকাগুলোর একাধিক স্থান দিয়েও বিভিন্ন মাদক সহজেই বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে মাদক পাচাররোধে নানা কৌশল নিয়ে আলোচনা হলেও মাদকের প্রবেশ বন্ধ করা যায়নি। এসব বৈঠকে বলা হয়, বৃহত্তর যশোর সীমান্তে ৫০- ৬০টি এবং উত্তরাঞ্চলের ৬ জেলার ৭২ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ১০টি ইয়াবা প্রস্তুত ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে এই তালিকা তুলে দেওয়া হয়েছে। একাধিক বৈঠকে কারখানাগুলো দ্রুত বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানানোর পর বিএসএফের পক্ষ থেকে ডজনখানেক কারখানা বন্ধ করা হয় ৷ অন্যান্য কারখানা বন্ধের তাগাদা দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত সেগুলো বন্ধ হয়নি বলে জানা গেছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইয়াবার মতো মাদকের থাবা রুখতে শুধু সেবনকারী ও বহনকারীদের গ্রেপ্তার করলে হবে না। এতে কোনো সুফল আসবে না। কারণ তারা একেবারেই নিম্নপর্যায়ের মানুষ। জরুরি হচ্ছে মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু আমরা আজও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালদের কাউকে গ্রেপ্তার হতে দেখিনি।
ইয়াবার বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক একজন মহাপরিচালক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, দেশে মাদকের ব্যবসার পেছনে কারা আছে। তাদের একটি তালিকা আমরা সরকারকে দিয়েছি। সেগুলো নিয়ে হয়তো কাজ করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল মো. কামরুল ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক নিয়ন্ত্রণে র্যাব কাজ করছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হাফিজ আল আসাদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, পুলিশ যে অভিযানগুলো চালায় সেখানে ৫-৬ ধরনের মাদক পাওয়া যায়। সবচেয়ে ভয়াবহভাবে পাওয়া যায় ইয়াবা। যা মিয়ানমার থেকেই আসছে। বর্তমান দেশেও তৈরি হচ্ছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে।
তিনি বলেন, এসব নিয়ে আমরা কাজ করছি। এর সঙ্গে কারা জড়িত? আশ্রয় বা প্রশ্রয়দাতা কারা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশ্রয় বা প্রশ্রয়দাতা কারা সেটা নিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক সহকারী মহাপরিদর্শক নামপ্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, পুলিশ সব সময় ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক নির্মূলে কাজ করছে। তবে একেবারেই মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, ইয়াবা ও অন্যান্য মাদক ব্যবসায়ীর তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আছে। তারপরও ইয়াবা বা ভয়ংকর সব মাদকের বিস্তার বন্ধ হচ্ছে না।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, দেশের কিছু মানুষের সঙ্গে আশেপাশের দেশের মাদক ব্যবসায়ীদের সংযোগ আছে। সেটিকে তারা কাজে লাগিয়ে এদেশে ইয়াবা ও অন্যান্য মাদকের ব্যবসা করছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সমাজের উচ্চপর্যায়ের কিছু মানুষ। যার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য বা অন্য কোনো পেশাজীবী বা রাজনৈতিক সংগঠনের লোক। তা না হলে দেশে এভাবে মাদকের প্রভাব পড়ত না।
তিনি বলেন, মাদক থেকে দূরে রাখতে কিছু সেমিনার হয়। কিন্তু এতে তেমন ফল আসছে না। মাদকের পৃষ্ঠপোষকরাও হয়তো এসব সেমিনার বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পেছনে বিনিয়োগ করে। যারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকছে। যদি মাদকের আশ্রয়স্থল ও পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় আনা না যায়, তাহলে কোনোভাবে মাদক নির্মূল করা সম্ভব না।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সমাজ বিজ্ঞানী শিরিন সুলতানা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, দেখা গেছে মাদকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সেমিনার করে লোক দেখানো হয়। সেসব জায়গায় বলা হয়, মাদকের সঙ্গে পৃষ্ঠপোষকদের গ্রেপ্তার করতে হবে এবং তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু এ পযর্ন্ত দেখলাম না যে, কোনো মাদক পৃষ্ঠপোষক গ্রেপ্তার হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইয়াবা বা যেকোনো মাদকের সঙ্গে যদি কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রশাসনের কেউ জড়িত থাকে তাহলে অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলে মাদক নির্মূল করা কিছুটা হলেও সম্ভব।
এনএইচবি/এসজি