বিশেষ প্রতিবেদন
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ‘নৌকা’ আওয়ামী লীগের জন্য শাঁখের করাত!
ছবি : সংগৃহীত
সংঘাত এড়ানোর ভাবনা থেকেই ২০১৬ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন সংশোধন করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যবহার শুরু হয়। দলের ভেতর স্বস্তিতো আসেইনি বরং উল্টো দলের ভেতর বিভেদ সৃষ্টি করে দিচ্ছে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এমনটাই মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
সারাদেশের ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৭৯টি। মেয়াদ উত্তীর্ণ ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভাগুলোতে চলছে নির্বাচন। গত ২১ জুন প্রথম ধাপে ২০৪টি এবং ২০ সেপ্টেম্বর ১৬০ টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৬টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১১ নভেম্বর। তৃতীয় ধাপে ১ হাজারটি ইউপি’র ভোট হয় ২৮ নভেম্বর এরপর চতুর্থ ধাপে ২৬ ডিসেম্বর ৮৪০টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হবে।
প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ২০৪টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ১৪৮টিতেই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেছেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র থেকে ৪৯ জন এবং তিনটি বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে বাকি ৭ জন প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেছেন।
নৌকা প্রতীকে জয়ী ১৪৮জন প্রার্থীর মধ্যে ১২০ জন সরাসরি ভোটে এবং বাকী ২৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। স্বতন্ত্রদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। এবারের নির্বাচনে দলগতভাবে বিএনপি অংশ নেয়নি।
১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত হয় ৮৪৬টি ইউপির নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন ১০০০। তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ১ হাজার ৮টি ইউপির নির্বাচন। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হয়েছেন ৪২৬ জন অপরদিকে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে বিজয়ী হয়েছেন ৪৪৫ জন। অর্থাৎ এখানে নৌকার প্রতীকের চেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি।
প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থীদের ছড়াছড়ি। দলীয় প্রতীক না জুটলেই বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। নৌকাকে ডুবাতে দলীয় নেতারাই আটঘাট বেঁধে রাজনীতির মাঠে নেমেছে বলে জানিয়েছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করায় নির্বাচনী ব্যবস্থা কতটুক শক্তিশালী হলো এমন প্রশ্ন করা হলে স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। অনেক বলেছি আর কথা বলব না।’
দলের হাই কমান্ডের নির্দেশের পরেও কেনো এতো বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছে এমন প্রশ্ন করা হলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছে তারা রাজনীতির অভিলাষ থেকেই হচ্ছে। দলের সিদ্ধান্তের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থজনিত সিদ্ধান্ত তাদের কাছে বড়। এজন্য বিদ্রোহী হচ্ছে।’
‘দল তো সবাইকে মনোনয়ন দিতে পারবে না, একজনকেই দিতে হবে। সুতরাং দলের সিদ্ধান্ত অবশ্যই সকলকে মেনে চলতে হবে। মেনে না চললে দলের সিদ্ধান্তের সাথে বিদ্রোহ করল বা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করল এটিই ধরে নেয়া হবে, তার জন্য যে শাস্তি সেটিই বিবেচিত হবে। যারা বিদ্রোহী হবে সেই শাস্তি সবার ব্যাপারেই প্রযোজ্য,’ যোগ করেন তিনি।
বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকাপ্রকাশকে জানান নির্বাচনে সবগুলো রাজনৈতিক দল যদি অংশ গ্রহণ করতো সেক্ষেত্রে হয়তো বিষয়টি একটু ভিন্ন রকম হতো।
‘সেখানে একটি প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ নির্বাচন হতো, তীব্র প্রতিযোগীতামূলক নির্বাচন হতো সেই ক্ষেত্রে কিন্তু আমাদের দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা হয়তো কমে আসতো। এখানে প্রতিযোগীতামূলক বিরোধী দল মাঠে না থাকার কারণে অনেকে নির্বাচন করার উৎসাহ পাচ্ছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং প্রতিযোগীতামূলক নির্বাচন করার জন্য দরকার হলো সকলের অংশগ্রহণ,’ তিনি বলেন।
বিদ্রোহী প্রার্থী দলের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ বলে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, যেহেতু প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো অফিসিয়ালি অংশগ্রহণ করছে না, আন-অফিসিয়ালি অংশগ্রহণ করছে ফলে একটু বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। আবার যদি পুরোপুরি দমন করি তাহলেও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন পড়ে গেছি শাখের কড়াতের মধ্যে আছি এদিকও কাটে ওদিকেও কাটে। বিদ্রোহী হওয়াও কারাপ। তাই নির্বাচন শেষ হলে দল থেকে স্ট্যাডি হওয়া উচিত।’
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে শুরু থেকেই মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। তবে সেই বাণিজ্যে কারা কীভাবে লেনদেন করেছে তার কোনো তথ্য প্রমাণ নেই। অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলে যারা জনপ্রিয় তাদের নাম কেন্দ্রে না পাঠিয়ে অর্থ লেনদেন এর ফলে অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় লোকের নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়। তাতে ওই ইউনিয়নে নৌকা বঞ্চিত প্রার্থীরাই নৌকার বিপক্ষে লড়াই করছে।
প্রতিটি সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্যদের অনুসারীদের একটি দল থাকে। সংসদ সদস্যরা চান তাদের অনুসারীরাই দলীয় মনোনয়ন পাক। অন্যদিকে জেলা উপজেলা পর্যায়ের সভাপতি সেক্রাটারিদের পছন্দ অপছন্দের প্রার্থীদের একটি গ্রুপ থাকে। ফলে অনেক সময় জেলা উপজেলা থেকে যে তালিকা দেয়া হয় সেই তালিকা কেন্দ্রে মূল্যায়িত হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য জেলা উপজেলা নেতাদের মধ্যে পৃথক গ্রুপিং এর কারণে ডুবছে নৌকা। সংসদ সদস্যদের পছন্দের প্রার্থী না থাকলেই পেছন থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে নৌকা ডুবিয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই বিভেদ দূর করতে না পারলে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন কেন্দ্রিয় নেতারা।
এসএম/এমএমএ/