স্বাধীনতার ৫০ বছর
বিস্ময়ের বাংলাদেশ
১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আবির্ভাবকালে বিশ্বব্যাপী দেশটির পরিচিতি ছিল মূলতঃ দুর্যোগপ্রবণ এবং ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ হিসেবে। বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অপুষ্টির সঙ্গে ছিল সম্পদের অপ্রতুলতা। এ প্রেক্ষাপটে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' হিসেবে উল্লেখ করেছিল।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর সেই বাংলাদেশ উঠে এসেছে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপ) আকার ছিলো মাত্র ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা, মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার। বর্তমানে (২০২০-২১ অর্থবছর) বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৫৫৪ ডলার। টাকার অংকে দুই লাখ ১৭ হাজার। যা রীতিমত বিস্ময়ের।
মূলত কৃষিকে মূলধন করে বাংলাদেশের অর্থনীতির গোড়াপত্তন। এখন শুধু কৃষি নয়, গড়ে উঠেছে বড় বড় শিল্প কারখানা। পোশাক, চামড়া, ওষুধ, পাট, তথ্য-প্রযুক্তির মতো খাতগুলো এখন আমাদের গর্ব। গত অর্থবছরে (২০২০-২১) প্রবাসী আয়েও গড়েছে রেকর্ড। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ। বেড়েছে শিক্ষার হার, জীবন যাত্রার মান। রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯.৭৬ বিলিয়ন ডলারে, ১৯৭৩ সালে যা ছিল মাত্র ৩৮৩ মিলিয়ন ডলার। ধারণা করা হচ্ছে ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
উন্নত দেশ গঠনে পদ্মা বহুমুখী সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, এলএমজি টার্মিনাল, রূপপুর পাওয়ার প্লান্ট, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি পাওয়ার প্লান্ট, রামপাল পাওয়ার প্লান্ট, দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম ডুয়েলগেজ রেল প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু রেলসেতু, ঢাকা-চট্রগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-রংপুর ফোরলেনসহ সারা দেশের উন্নয়ন ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রেও গুরুত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মাথাপিছু আয় ও জিডিপির প্রবৃদ্ধি
১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ছিল মাত্র ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। আর মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)’র হিসাবে, সব রেকর্ড ভেঙে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে পৌঁছে জিডিপি। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালে বিশ্বে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। গত বছরের মার্চে দেশে করোনা ধরা পড়লে থমকে যাওয়া বিশ্বের মতো বাংলাদেশের জিডিপিও তিন দশমিক ৫১ শতাংশে নেমে আসে। কম হলেও বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতসহ অন্য দেশের তুলনায় এটিও ছিল খুব ভালো অবস্থান। গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০২১-২২ বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি সম্ভব বলেই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাজেটে ৭৬৭ শতাংশের বেশি বরাদ্দ
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দায়িত্ব নিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ৭৮৬ কোটি টাকার প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন। এদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন শেখ হাসিনা সরকার। এরমধ্যে চলতি অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটেই ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশকে বদলে দিতে ফাস্ট ট্র্যাকসহ অন্য বড় বড় প্রকল্পে বরাদ্দ দিতেই বেশি করে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সুপারিশ জাতিসংঘে অনুমোদিত
স্বল্পোন্নত দেশ হতে বাংলাদেশের উত্তরণের সুপারিশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অনুমোদিত হয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬ তম বৈঠকের ৪০তম প্ল্যানারি সভায় ২৪ নভেম্বর এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, এই ঐতিহাসিক অর্জনকে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার এক মহান মাইলফলক হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ’প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের যে অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন যাত্রা-এটি তারই একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।’
বাংলাদেশকে ২০২১ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরব্যাপী প্রস্তুতিকালীন সময় প্রদানের সুপারিশ করেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ ইতোমধ্যে সিডিপি এর সুপারিশ অনুমোদন করেছে। আশা করা হচ্ছে, পাঁচ বছর প্রস্তুতিকাল শেষে বাংলাদেশের উত্তরণ ২০২৬ সালে কার্যকর হবে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ’আজকের বাংলাদেশ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে এলডিসি গ্রাজুয়েশন হলেও প্রভাব পড়বে না। কারণ চ্যালেঞ্জের চেয়ে দেশে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ায় সম্ভাবনাই বেশি। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি পাল্টে দিয়েছে দেশকে।
রাজস্ব আদায়ে রেকর্ড
১৯৭২-১৯৭৩ সালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার গঠন করে ২৫০ কোটি টাকা রলক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এর বিপরীতে আদায় হয় ১৬৬ কোটি টাকা। করদাতা-বান্ধব পরিবেশ তৈরি হওয়ায় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এনবিআর সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল বলেন, ’বাংলাদেশ এশিয়ার নব্য টাইগার হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।’ তিনি আরও বলেন, ’আমাদের এখন লক্ষ্য এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি অর্জন। বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা এবং ২০৪১ সালের সুখী, সমৃদ্ধ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা। হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) সর্বশেষ গ্লোবাল রিসার্চেও বলা হয়েছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যা বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২তম।’
সব সূচকে বিস্ময়কর অগ্রগতি
যুদ্ধবিধ্বস্ত ও ধ্বংসস্তুপের বাংলাদেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছে বলে জানান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, ’স্বাধীনতার সময় দখলদার বাহিনীরা বাংলাদেশের অবকাঠমোসহ সব জায়গা ধ্বংস করে দেয়। তাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করতে অল্প সময়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিধ্বস্ত বাংলাদেশে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে এসে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য দেশ পুনর্গঠনে ২১ দিনের মধ্যে পরিকল্পনা কমিশন তৈরি করেন বঙ্গবন্ধু। অত্যন্ত শক্তিশালী পরিকল্পনা কমিশন করেছিলেন অর্থনীতিবিদদের নিয়ে। যা ভারত তিন বছর পর, পাকিস্তান ছয় বছর পর করেছিল। তিনি দেশের উন্নয়নে কতোটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন এ ব্যবস্থা গ্রহণ দেখলেই বুঝা যায়। সংবিধান তৈরি, নির্বাচন প্রদান, বিএডিসি, রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটসহ অনেক প্রতিষ্ঠান সাড়ে তিন বছরে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। কৃষিক্ষেত্রে যে বিপ্লব তার ভিত্তি বঙ্গবন্ধুই গড়েছিলেন। কাজেই পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় আমূল পরিবর্তন আসে বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার পথ ধরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯০ ডলার থেকে ২৫৫৪ ডলারে এসে গেছে। দারিদ্র্য ৮৪ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশ দরিদ্র থেকে উন্নয়নশীল হয়েছে। তার মধ্যে গত ১৩ বছরে যে অর্জন তা বিস্ময়কর। অনেক দূরে নিয়ে গেছি আমরা দেশকে। অগ্রগতিরকাল বলা যায় একে। কারণ ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কাজেই ৭২ সালের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। এক কথায় সব সূচকে অগ্রগতি হয়েছে দেশের। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম হয়ে গেছে।
ড. শামসুল আলম বলেন, ‘২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থাকলেও বর্তমানে তা ২০ নেমে এসেছে। হতদরিদ্রও অর্ধেকে কমে ১০ শতাংশে এসেছে। রিচার্ভ বেড়েছে অকল্পনীয়, ৫০ বিলিয়ন ডলার ছুঁইছুঁই করছে। সব মিলিয়ে বলা যায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিস্ময়।
ড. শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা থেমে নেই। উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করা হচ্ছে। রূপকল্প-২০২১ প্রণয়ন করে ২০৩১ এর মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ ও ৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নত হবো। ১০০ বছরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ব-দ্বীপ পরিকল্পনায়। কাজেই বলা যায় ২০২৫ সালে দুই অংকের অর্থাৎ ১০ শতাংশের প্রবৃদ্ধিতে পৌঁছাতে পারব।
রপ্তানি আয় ও রিজার্ভ
১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন (২৯ দশমিক ৭ কোটি) ডলার। ৮০ দশকে তৈরি পোশাক শিল্প (আরএমজি) খাতের দিকে ঝুঁকেন অনেকে। বর্তমানে তিন হাজারের বেশি কারখানায় কাজ করে ৪৫ লাখ শ্রমিক। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানি দেশের মর্যাদাও অর্জন করেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। গ্রিন ফ্যাক্টরির রেকর্ডও অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
পোশাক কারখানার সিংহভাগ নারী। নারীদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১’। নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি কার্যক্রম। এভাবে আয় বাড়তে থাকায় নারীদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটেছে ব্যাপকভাবে। শুধু তাই নয়, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে মেড ইন বাংলাদেশ গার্মেন্টস থেকে শিপ, লেদারগুড দেশেও পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ১০০টি ইনোনমিক জোন স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। এর ফলে রফতানি আয়ও বাড়ছে। এভাবে রপ্তানি আয় বেড়ে গত বছর হয়েছে ৩৯ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছে ৪৩ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ছুঁইছুঁই রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ।
স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ দৃশ্যমান
২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা ঘোষণা করে সরকার। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে চার হাজার ৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লাখ। ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা কোটি ৪৬ লাখে উন্নীত হয়েছে। সেবা প্রদান প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতেই চালু করা হয়েছে ই-পেমেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিং। বর্তমানে বিকাশ, রকেট, নগদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যেমে সারা দেশে পৌছে গেছে এ সেবা। বিভিন্ন ভাতা গ্রহণকারীসহ গ্রাহক ১০ কোটিতে পৌঁছেছে। দিনে লেনদেন হচ্ছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। যা এক যুগ আগে কল্পনাই ছিল। ভূমি ব্যবস্থাপনাতেও লেগেছে ডিজিটালের ছোঁয়া। অনলাইনে জমির নামজারী এবং খাজনাও দেওয়া যাচ্ছে।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ
কৃষিতে কৃতিত্ব এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন কৃষিখাতে অভূতপূর্ব কিছু সাফল্যের জন্য বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ বারবার আলোচিত হয়েছে। প্রায় ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে চতুর্থ, সবজি উৎপাদনে চতুর্থ, আলু উৎপাদনে সপ্তম স্থানে পৌছানো সম্ভব হয়েছে। বিশ্বে চালও রপ্তানি করা হচ্ছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড বোরো উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি টনেরও বেশি, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ সহ বিভিন্ন নীতি প্রণয়নের ফলে কৃষকরা ব্যাপকভাবে সুফল পাচ্ছে ।
সবার ঘরে বিদ্যুৎ
স্বাধীনতার পরে দেশে বিদ্যুতের কথা কল্পনা মনে হতো। শহরে কিছুটা থাকলেও গ্রামের মানুষকে হারিকেন, কুপি জ্বালিয়ে রাত পার করতে হতো। কিন্তু ৫০ বছরের ব্যবধানে পাল্টে গেছে চিত্র। বর্তমানে ২২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে দেশ। তবে গ্রিড পর্যায়ে সঞ্চালনের সমস্যা থাকায় আগে বেশি থাকলেও বর্তমানে সর্বোচ্চ প্রকৃত উৎপাদন ৯ হাজার ৩৩৮ মেগাওয়াটে নেমে গেছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। আরইবিসহ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে সারা দেশে ৯৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। এ বছর শতভাগ করা হবে। এ জন্য প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে সোলার প্যানেলেরও ব্যবস্থা করেছে শেখ হাসিনার সরকার।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি
হতদরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বিস্তৃত করতে বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত ও দুঃস্থ মহিলা ভাতা, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃকালীন ভাতাসহ ভাতার হার ও আওতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০০৮-২০০৯ সালে এই খাতে মোট বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা, বর্তমানে এ কার্যক্রমে বরাদ্দের পরিমাণ ২৫ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা।
কমেছে দারিদ্র্যের হার
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮৮ শতাংশ। ২০০০ সালে ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশে নামে। আর ২০১০ সালে ৩১ দশমিক ৫ এবং ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় ২৪ দশিমিক ৩ শতাংশ। ২০১৯ সাল শেষে সাড়ে ২০ শতাংশে নেমেছিল। এদিকে ২০০০ সালে অতিদারিদ্রের হার ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ থাকলেও ২০১০ সালে কমে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসে। যা ২০১৯ শেষে অতি দারিদ্র্যের হার সাড়ে ১০ শতাংশে নামে। তবে গতবছর করোনা ভাইরাসে দেশ থমকে গেলে দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্য দুই কোটিরও বেশি বেড়েছে বলে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা জানিয়েছে।
অবকাঠামো
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের সকল প্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ শিল্প কারখানা ধ্বংস করে যায়। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী শুধু গ্রামীণ এলাকায় ৪৩ লাখ বাড়ি ধ্বংস করে পাকিস্তানি বাহিনী। ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশ গৃহায়ণ থেকে শুরু করে যোগাযোগ, শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করে। মেট্রো রেল, পদ্মা বহুমুখী সেতু, এলএমজি টার্মিনাল, রূপপুর পাওয়া প্লান্ট, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি পাওয়ার প্লান্ট, রামপাল পাওয়ার প্লান্ট, দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম ডুয়েলগেজ রেল প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু রেলসেতু, ঢাকা-চট্রগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-রংপুর ফোরলেনের মতো মেগা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো উন্নয়নের অগ্রযাত্রার চিহ্ন বহন করে।
শিক্ষা ব্যবস্থা
গত ৫০ বছরে মানব উন্নয়ন সূচকে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। দেশের শিক্ষায় প্রবেশাধিকার বাড়ানোর জন্য সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে প্রাথমিকে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ১৮ শতাংশ কমানো সম্ভব হয়েছে। ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের কারণে ২০১৯ সালে স্বাক্ষরতার হার দাঁড়িয়েছে ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ১৯৭৪ সালে ছিল ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
স্বাস্থ্য খাত
স্বাস্থ্য খাতে নিরব বিল্পব ঘটেছে গত ৫ দশকে। যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে বাংলাদেশ শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার ৭৫ শতাংশ কমেছে। যদিও প্রজনন হার ২ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে, যা ১৯৭০ এর দশকে ছিল ৭ শতাংশ। কম খরচে চিকিৎসার ভালো মানের চিকিৎসা দিতে সক্ষম হয়েছে ২০১১ সালের মধ্যে।
জেডএ/জেএকে/এএন