ঝুঁকির মুখে এজেন্ট ব্যাংকিং
এখন দেশব্যাপী জনপ্রিয় ও লেনদেনের সহজ একটি মাধ্যমের নাম এজেন্ট ব্যাংকিং। সারাদেশে ২৫টি ব্যাংকের ১৪ হাজারের বেশি এজেন্ট আছেন। এদের আওতায় প্রায় এক কোটি ৬১ হাজার অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। এর মাধ্যমেই একেবারে গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে ব্যাংকিং সেবা। বর্তমানে এসব অ্যাকাউন্টে বিপরীতে আমানত ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর এজেন্ট ব্যাংকিং চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্সও এসেছে প্রায় লাখ কোটি টাকা। ঋণ দেওয়ার পরিমাণও প্রায় আট হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের দোড়গোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়া এজেন্ট ব্যাংকাররা এখন গভীর সংকটের মুখোমুখি। আছেন নানা ঝুঁকিতে। দেশব্যাপী এজেন্ট ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতির মত ঘটনা। সেই ঝুঁকি নিয়েও এজেন্ট ব্যাংকাররা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এখন আবার মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে খোদ ব্যাংকগুলোই। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালাকে উপেক্ষা করে গ্রামাঞ্চলে যেসব এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিং ভালো হচ্ছে সেসব এলাকায় ব্যাংকের শাখা, উপ-শাখা খুলতে তৎপর একাধিক ব্যাংক। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ এজেন্টরা। তারা প্রতিকার চেয়ে শরণাপন্ন হয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় ১১ হাজার শাখার অনুমোদন দিয়েছে। এর ৫২ শতাংশ শহর এলাকায় এবং ৪৮ শতাংশ গ্রামীণ এলাকায়। তারপরও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সুবিধা না পৌঁছায় সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান নজর দেন কীভাবে সবাইকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা যায়। বিষয়টি আমলে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে ব্যাংকিং সুবিধায় আনতে বিভিন্ন ব্যাংককে অনুমোদন দেয়। আর তাতেই গত এক দশকে পাল্টে গেছে চিত্র।
সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ৩০টি ব্যাংককে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘গাইডলাইনস ফর এজেন্ট ব্যাংকিং অপারেশন ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি গাইডলাইন তৈরি করে। এই গাইডলাইনে এজেন্ট ব্যাংকিং পরিচালনার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ সব নির্দেশনার একটি হচ্ছে, লেনদেনে করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত সময় মতো। তবে ব্যাংক যদি মনে করে কোনো রিস্ক নেই তাহলে সময় কম-বেশি হতে পারে। ক্যাশ জমা ও উত্তোলন থেকে শুরু করে এজেন্টরা কি কাজ করতে পারবে সেটি স্পষ্ট করা হয়েছে। এজেন্টরা কি করতে পারবে না সেটি উল্লেখ করে গাইডলাইনে বলা হয়েছে, কোনো ইউনিট ও মাস্টার এজেন্ট একাধিক ব্যাংকের এজেন্ট হতে পারবে না। বৈদশিক মুদ্রাও লেনদেন করতে পারবে না। ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই গ্রামাঞ্চলে তিনটি আউটলেটের বিপরীতে শহরে একটা আউটলেটের অনুপাত মেইনটেইন করতে হবে।
সূত্র জানায়, ইউনিট (ব্যক্তি) ও মাস্টার (ব্যবসা প্রতিষ্ঠান) এজেন্টের মাধ্যমে সারাদেশে এই এজেন্ট ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এসব এজেন্টের কাছে যে কেউ তাৎক্ষণিকভাবে যেমন আমানত রাখতে পারছেন তেমনি ঋণও নিতে পারছেন। শুধু তাই নয়, প্রবাসীরাও দেশে স্বজনের কাছে রেমিট্যান্স পাঠতে পারছেন।
বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকিং এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে, ব্যাংকিং সময়ের পরও এজেন্টদের লেনদেন করতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংককিং সময়ের পরও অনেক টাকা জমা হচ্ছে আউটলেটে। এই টাকা জমা রাখতে হচ্ছে এজেন্টদের নিজ দায়িত্বেই। আর তাতেই ঝুঁকি বাড়ছে। চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটছে।
নোয়াখালীর চৌমুহনী পৌরসভা এলাকা থেকে সম্প্রতি ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের এক কর্মীর কাছ থেকে ১৯ লাখ টাকা ছিনতাই হয়েছে। এজেন্ট থানার শরণাপন্ন হলে ৩৩ দিন পর পুলিশ চার ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে। এভাবেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অহরহ ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডাচবাংলা ব্যাংকের এজেন্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার বসিলা রোডের লাইভ ট্রেডার্সের মহিউদ্দিন হাওলাদার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বাসাভাড়া, কর্মচারীদের বেতন সব কিছুই আমাদের দিতে হচ্ছে। শর্ত মেনেই এজেন্ট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছি। কমিশনই আমাদের আয়ের উৎস। এক লাখে ২০০ টাকা কমিশন পাই। লেনদেন বেশি হলে লাভও বেশি হয়। কিন্তু অনেককে লাভে না এলেও ঝুঁকিতেই থাকতে হচ্ছে। নতুন যারা, তাদের লস করেই এ ব্যবসা করতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে ব্যাংকের লেনদেনের পর গ্রাহকের জমা করা টাকা নিয়ে। আমাদের রিস্কে তা রেখে দিতে হয়। এ সুযোগ নিয়ে অনেক জায়গায় ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি হচ্ছে। তখনই ঝামেলা হচ্ছে। তাই অনেকে ঝুঁকি মোকাবিলা করতে না পেরে এজেন্ট ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছে, বর্তমানে এ ব্যবসা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন লেগে থাকলে লাভে আসা সম্ভব। বর্তমানে ডাচ বাংকের ৬০০০ এজেন্ট। এদের অনেকের খারাপ অবস্থা। তবে লাভ করতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। অন্যান্য ব্যবসার মতোই এখানেও ধৈর্য ধরে থাকতে হবে।'
অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা দেড় কোটি ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে (জুন পর্যন্ত) দেখা গেছে, এজেন্ট ব্যাংকিং-এ অ্যাকাউন্টধারীর (হিসাবের নম্বর) সংখ্যা এক কোটি ৬০ লাখের বেশি দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ পাঁচটি ব্যাংকের হিসাব নম্বর। তাতে ব্যাংক এশিয়ার হচ্ছে ৫৩ লাখের বেশি বা ৩৩ শতাংশ, ডাচ বাংলা ব্যাংকের প্রায় ৩১ শতাংশ, ইসলামী ব্যাংকের ১৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ, আল আরাফা ইসলামী ব্যাংকের ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ ও অগ্রণী ব্যাংকের ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
এ সব হিসাব নম্বরে আমানত জমা হয়েছে ২৮ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। যা এক বছর আগে ছিল ২০ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানত হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকের ৩৯ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া ডাচ বাংলা ব্যাংকের ১৫ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়ার ১৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, আল আলাফা ব্যাংকের ১২ শতাংশ ও অগ্রণী ব্যাংকের ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ আমানত জমা হয়েছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে।
শুধু তাই নয়, ঋণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। ৯৭ দশমিক ৪১ শতাংশ ঋণ দিয়েছে পাঁচটি ব্যাংক। জুন পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা।
এরমধ্যে সর্বোচ্চ ঋণ দিয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। ঋণের পরিমান ৬২ দশমিক শতাংশ। এ ছাড়া সিটি ব্যাংক ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়া ১২ দশমিক ৫০, ডাচ বাংলা ব্যাংকের ৫ দশমিক ৯১ ও আল আলাফা ব্যাংক ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ ঋণ দিয়েছে। এ ছাড়া এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্সও পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। গত জুন পর্যন্ত প্রবাসীরা ৯৭ হাজার কোটি টাকার বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৬৮ হাজার কোটি টাকা। করোনাকালেও রেমিটেন্স এসেছে ২৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। ৯৭ শতাংশ রেমিট্যান্স এসেছে পাঁচটি ব্যাংকের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিকার চেয়েছেন এজেন্টরা। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গত প্রায় এক দশকে ব্যাংক সেবায় রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে দেশে। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক এজেন্ট ভল্ট নির্মাণ, আসবাবপত্র, ল্যাপটপ কেনার জন্য লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগও করেছেন। কিন্তু ব্যাংকগুলো এখন এজেন্টদের বাদ দিয়ে উপ-শাখা বা শাখা স্থাপন করছে। তাদের আউটলেট অন্যত্র সরিয়ে নিতে বলছে।
এ ব্যাপারে ব্র্যাক ব্যাংকের ধামরাই বাজারের এজেন্ট জিন্নাত ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘প্রায় ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ঝুঁকি ও ভোগান্তি সহ্য করে এ পর্যায়ে এসেছি। এলাকায় ভালো পরিচিতি লাভ করেছি। কিন্তু ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অফিস থেকে গত ১ মার্চ চিঠি দিয়ে আউটলেট ধামরাই থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছে। তিনি বলেন, এতে আমি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব।
এমনতাবস্থায়, বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।কারণ এটা এজেন্ট ব্যাংকিং নীতিমালা ও নৈতিকতা বিরোধী। তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তা থাকলে সব সময় লেনদেনে সমস্যা নেই। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংক সময় ছাড়া লেনদেন করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অনেক এলাকায় ছিনতাইকারীরা এজেন্টদের টাকা লুট করে নিচ্ছে।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন,‘বর্তমানে এজেন্টদের লেনদেনে কোনো ঝুঁকি নেই। কারণ প্রতি আউটলেটে ভল্ট রয়েছে। দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুবই সজাগ। তা ছাড়া গ্রাহকের বীমা করা আছে। কোনো টাকা ছিনতাই হলে তারা বিমার আওতায় ক্ষতিপূরণ পাবে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ব্যবসা বাড়লে সেখানে উপ-শাখা বা শাখা করা হবে এটাই স্বাভাবিক। এতে গ্রাহকরা আরও বেশি ও দ্রুত সেবা পাবে।’
ব্যাংকিং সময় ছাড়া লেনদেন করতে এজেন্টরা ঝুঁকিতে পড়ছে। বিকল্প কোনো পথ বের করা হবে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘এটা আমার আগে জানা ছিল না। তাই কিছু বলতে পারছি না। তবে সংশ্লিষ্ট পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের নিরাপত্তার জন্য কিছু করার সুযোগ থাকলে তা করা হবে।’
এনএইচবি/আরএ/