কেন্দ্রীয় নেতারা হালুয়া রুটির ভাগ পেতে ব্যস্ত- অভিযোগ তৃণমূলের
নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন করতে মরিয়া বিএনপির ভরসা এখন তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে নেতা-কর্মীদের মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছে দলটি। গত ২২ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী যে কর্মসূচি চলছে সেখানে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে দলের হাইকমান্ড থেকে।
কিন্তু মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় নেতারা সরকারি দলের হালুয়া রুটির ভাগ পেয়ে আন্দোলনে রাজপথে নামতে গড়িমসি করে সময় অতিবাহিত করছেন। আবার তারা দলের পদ আঁকড়ে ধরে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। অন্যদিকে তাদের পরিবারের সদস্য, যারা সরকারি চাকরিতে আছেন, তাদের সরকারের হয়রানির শিকার হওয়ার পথ বন্ধ রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। সেজন্য নেতাদের আন্দোলনে আন্তরিকতা দেখা যায় না।
তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, ঢাকা তথা কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক অবস্থান অরক্ষিত রেখে তৃণমূলে পিকনিক সফরে (সাংগঠনিক সফর) কার্যকর কোনো সফলতা আসবে না।
ছাড়া দলটির ভেতর-বাইরে সরব আলোচনায় হচ্ছে বিএনপি এই মুহূর্তে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই।
তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, জেলা শহরগুলোতে অতীতে যে রকম আন্দোলন হয়েছে, তার তুলনা হয় না। কিন্তু আমরা দেখেছি ঢাকায় তেমন ভাবে কোনো আন্দোলন গড়ে উঠেনি। অদূর ভবিষ্যতে ঢাকার রাজপথ আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে সেই সাংগঠনিক দক্ষতাও চোখে পড়ছে না। দায়িত্বশীল নেতারা কমিটি গঠনে আর্থিক সুবিধা পেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।
তারা অভিযোগ করে বলেন, কর্মসূচি ঘোষণা করে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ বিএনপি। আর সেই কর্মসূচি সফল করতে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ঢাকায় ছুটে আসতে হয়। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা না এলে ঢাকা মহানগরের অধিকাংশ নেতাদের কেউ রাজপথে বের হন না। অথচ তারাই কেন্দ্রে বসে থেকে দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন, জেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাচ্ছেন। তাহলে দায় কি শুধু তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের? বাস্তবতা হচ্ছে ঢাকায় যদি মানুষ আন্দোলন না দেখে, তবে কেউ রাজপথে আর বের হবে না। তৃণমূল থেকে নেতা-কর্মীদের যদি ঢাকায় এসে আন্দোলনে শরিক হতে হয় তাহলে এত এত কেন্দ্রীয় নেতাকে ঢাকায় বসিয়ে রেখে দলের লাভটা কোথায়? বরং সময়ের দাবি, কেন্দ্রীয় কমিটির আকার ছোট করে নেতাদের কর্মীতে রূপান্তর করতে হবে। নতুবা আন্দোলনে এই সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব হবে না।
ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হুমায়ুন আহমেদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যেকোনো আন্দোলনের জন্য জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত। কিন্তু কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটাতে না পারলে তৃণমূল দিয়ে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না, অতীতেও আন্দোলন সফল হয়নি।
মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা বিএনপির নেতা মোকতার হোসেন তারা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে অতীতে আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে হামলা-মামলার শিকার হয়েছি। শনিবারও (২৭ আগস্ট) আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা হামলার শিকার হয়েছি। কেন্দ্রীয় পর্যায় কোন ধরনের আন্দোলন চায় সেটা বুঝতে পারছি না। তাদের আন্দোলনের ধরন বুঝতে পারলে আমাদের মতো তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সুবিধা হতো।
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব আতাউল হক মিন্টু ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা তৃণমূল নেতা-কর্মীরা আন্দোলন সংগ্রামে পরীক্ষিত, নতুন করে পরীক্ষা দেওয়ার কিছু নেই। শনিবার পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি পালনের সময় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে। এখন মামলা হবে, আমরা আবারও পুলিশের হয়রানির শিকার হব। বার বার তৃণমূল নেতা-কর্মীদের উপর কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়াটা মাঝে মাঝে মনে হয়, এসব কর্মসূচি কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়মুক্তির কর্মসূচি নয় তো?
নেত্রকোনা জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি ফারদিন চৌধুরী রিমি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, শনিবার (২৭আগস্ট ) কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়েছি। কেন্দ্রঘোষিত এসব কর্মসূচির মাধ্যমে পাড়া মহল্লায় সংঘাতের আশঙ্কা থাকবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বিএনপির সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে রাজধানীসহ তৃণমূল সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান জানান দিতে শুরু করেছে। সাংগঠনিক দুর্বলতা এখন খুব একটা নেই। ঢাকায় কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে তৃণমূল পর্যায়েও কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। ধারাবাহিকতায় তৃণমূলে কর্মসূচি শেষ করে আবারও ঢাকায় বড় ধরনের কর্মসূচি পালন করা হবে। ঢাকায় কর্মসূচি বাস্তবায়নে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ঢাকায় ডেকে আনতে হয় না, অনেকে নিজ ইচ্ছায় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে।’
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকাপ্রকাশ কে বলেন, ‘২০১৪ সালে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের যে আন্দোলন হয়েছে তা অতীতের সব আন্দোলনের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। তবুও সরকার রয়ে গেছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলন ঢাকাবাসী দেখেছে, তৃণমূল দেখেনি। অথচ এরশাদকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘গ্রাম পর্যায়ে বিএনপির আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। সেই আন্দোলনে দলের বাইরে থাকা সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করেছে। জনগণ এখন সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বিএনপির ক্ষমতায় আসা বহু দূরের বিষয়। ঢাকায় আন্দোলন করতে হবে। বিভাগীয় শহর থেকে আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। ঢাকা মহানগরকে মহাআনন্দে রেখে তৃণমূলে অহেতুক ছুটাছুটি করে কোনো লাভ হবে না।
তিনি বলেন, আমরা যত কথাই বলি না কেন; উপজেলা পর্যায়ের আন্দোলন কখনো সরকারকে পায় না। সরকারকে পায় কনসার্ন বডি আঘাতপ্রাপ্ত হলে। আমরা কোনোদিন থানা ঘেরাও দিচ্ছি না, পানির দাম বেড়েছে আমরা ওয়াসা ভবন ঘেরাও দেইনি। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, আমরা বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাও করিনি, গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, আমরা ঘেরাও করিনি। ইতোপূর্বে আমরা এই কাজগুলো করেছি। এই কনসার্ন বডিতে আঘাত করলে সরকারের লাগে।
এই নেতা আরও বলেন, ‘মুখে যত কথা বলা হোক বাস্তবতা হচ্ছে দলের প্রত্যেকটা লোকের চলার গতিবিধি নির্বাচনকেন্দ্রিক। সরকার পতনের ভাবনা তাদের নেই। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত দলের সমগ্র পর্যায় থেকে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সরকার পতনের ভাবনা না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত কর্মসূচি দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আন্দোলনের সফলতায় নির্ভর করে নির্বাচনের সফলতা। আন্দোলনে জয়ী হতে পারলে নির্বাচনে অনায়াসে জয়ী হওয়া যায়। কথায় আছে হুজুগে বাঙালি একদিকে যায়, তিন দিকে যায় না। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কর্মী পর্যায়ে ওই স্পিড আনা যাচ্ছে না। অনেকেই এমপি হওয়ার বাসনা নিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বসে আছে।’
তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, প্রেস ক্লাবের সামনে তিন হাজার লোক ধরে না। অথচ আমরা খুশিতে গদগদ হয়ে যাচ্ছি। বক্তার সামনে ৩০ ফিট রাস্তা এখন নেই। তাহলে মহানগরকে দুই ভাগ করে লাভ কী হলো? আর মহানগরের দুই নেতাকে নিয়ে এত লাফালাফি হচ্ছে কেন? তৃণমূল আন্দোলন অতীতে করেছে ভবিষ্যতেও করবে। কেন্দ্রের কাজ হলো কর্মসূচি দেওয়া, মনিটরিং করা। ইউনিটগুলো ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। সম্প্রতি দেখতে পেলাম কর্মসূচি পালনে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু সেই চিঠিতে ঢাকা মহানগরকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। তাহলে হেড কোয়ার্টার মানে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কোনো কর্মসূচি থাকছে না?’
প্রসঙ্গত, গত ২২ আগস্ট থেকে তৃণমূলে কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা দেওয়া হলেও মহানগরকে বাদ রাখা হয়েছে। দলের ভেতরেই প্রশ্ন উঠেছে- কেন, ঢাকায় কী ওয়ার্ড নেই? তাহলে ওয়ার্ড বলতে কী বুঝানো হয়েছে? গ্রামের ওয়ার্ডও ওয়ার্ড; ঢাকার ১৩৭টি ওয়ার্ডও তো ওয়ার্ড। এই প্রশ্ন উঠার পর বলা হলো, ঢাকা মহানগর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে উপজেলায় কর্মসূচি দেওয়া হলো তাদের সঙ্গে কথা না বলে। তাহলে মহানগরে কর্মসূচি দিলে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে কেন? তার মানে এইখানে সংগঠন রান করানোর মতো অবস্থায় নেই।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বিএনপি এই মুহূর্তে যে কর্মসূচি পালন করছে তা শুধু ঢাকাবাসীর জন্য সীমাবদ্ধ নয়। জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশের মানুষের গণদাবিতে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার পতনে গণআন্দোলনের মাধ্যমে গণঅভূত্থানের ক্ষেত্র তৈরিতে দেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করাই উদ্দেশ্য। কেননা আমি মনে করি শুধু ঢাকায় দাবি আদায়ে সোচ্চার হলেই সমাধান হবে না।’
এনএইচবি/এসএন