পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর শেষ কোথায়
রাজধানীর হাতিরঝিল থানা হেফাজতে সুমন শেখ ওরফে রুম্মন শেখের মৃত্যুর ঘটনার পর আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়টি। যদিও পুলিশ এই মৃত্যুর দায় কোনোভাবেই নিতে চাচ্ছে না।
তবে সাধারণ মানুষের অভিযোগ পুলিশ হেফাজতে কারো মৃত্যু হলে তেমন কোনো বিচার হয় না। পুলিশের অপরাধের শাস্তি হলে পুলিশ সদস্যরা এ সব বিষয়ে সতর্ক থাকতেন। আসামিদের প্রতি যত্নশীল হত। কিন্তু বিচার না হওয়ায় পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছে।
যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নিষেধাজ্ঞার পর দেশে ক্রসফায়ারে ঘটনা কমে এসেছে। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দুটি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে।
কিন্তু হেফাজাতে মৃত্যু থেমে নেই। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছর ২০২১ সালে ৫১টি ক্রসফায়ার ও ২৯টি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ক্রসফায়ার বাদ দিয়ে ২০২০ সালে হেফাজতে মৃত্যু ২৪টি, ২০১৯ সালে হেফাজতে মৃত্যু ৩২টি, ২০১৮ সালে ৫৪টি এবং ২০১৭ সালে ৩৫টি।
অবশ্য একাধিক গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ বছরে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ৩২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই তথ্য মতে, ২০২০ সালে ১১ জন মারা গেছে। ২০২২ সালে মারা গেছে ৪৪ জন।
পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নিষ্ঠুর নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে অনেক। কিন্তু বিচার চেয়ে আইনের আশ্রয় নিয়েছেন খুব কম সংখ্যক মানুষ।
২০১৩ সালে হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যু নিবারণ আইন প্রণয়ন করে। জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই আইনটি প্রণয়ন করে।
এই আইন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত মামলা হয়েছে মাত্র ১৯টি। বাংলাদেশের আদালতে ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এ আইনে সর্বপ্রথম রায় প্রদান করা হয়। ২০১৪ সালে পুলিশের হেফাজতে জনি নামে এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় পাঁচ জন আসামির মধ্যে তিন জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। অপর দু্ই জনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ১৪টি মামলায় মামলা ত্রুটিপূর্ণ বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে আটক, জিজ্ঞাসাবাদের শিকার এমন বেশ কয়েকজন বলেছেন যে, তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কিন্তু কোনো মামলা করেননি।
কেউ কেউ জানিয়েছেন, নির্যাতিত হলে যে মামলা বা অভিযোগ করা যায়, সেটিই তারা জানেন না। আবার সচেতন ভুক্তভোগীরাও বলছেন, তারা জানলেও কতটা প্রতিকার পাবেন সে আশঙ্কায় এবং ভয়ে মামলা করতে রাজি হননি।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক মানুষ নির্যাতিত হয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করে সেই মামলায় এ পর্যন্ত একটা বিচার হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করলে সেটা পুলিশই তদন্ত করে। যার ফলে পুলিশের অভিযোগ পুলিশরাই এড়িয়ে যায়। তা ছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হলে তারা প্রথমে মামলা নিতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে চাপে পড়ে অথবা সরকারি চাপে মামলা নেয়। কিন্তু এসব মামলার বিচার হয় না। একারণে অনেক সময় সাধারণ মানুষের অভিযোগটি পুলিশের দিকেই থাকে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, এ পর্যন্ত পুলিশের কোনো অপরাধে তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে দেখিনি। সাধারণ মানুষ যদি পুলিশের অপরাধের জন্য তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে দেখত তাহলে হয়ত পুলিশের প্রতি তারা কিছুটা আস্থা পেত। সাধারণ মানুষ দিন দিন একেবারেই পুলিশের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে কারণ পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২০ আগস্ট হাতিরঝিল থানায় পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হয় সুমন শেখের (২৫)। তার স্ত্রী জান্নাত আক্তার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘গ্রেপ্তারের পর আমার স্বামীকে অনেক নির্যাতন করা হয়। তার কাছ থেকে পুলিশ নাকি অনেক টাকা উদ্ধার করেছে। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। পুলিশের নির্যাতনের কারণে আমার স্বামী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত বিচার চাই’।
অবশ্য পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার আজিমুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘সুমন যখন আত্মহত্যা করে তখন ডিউটিরত পুলিশ সদস্যদের গাফিলতির বিষয়টি সিসিটিভি ফুটেছে উঠে এসেছে। সেই কারণে ২ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছি। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দেওয়ার পরে আমরা অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করব’।
পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা আসলে ডিউটি অফিসার ও পুলিশের সেন্ট্রিদের গাফিলতির কারণে ঘটে। তারাই এটির দায়িত্বে থাকেন। যদি থানা হেফাজতে কোনো আসামির মৃত্যু হয় তাহলে ডিউটিতে থাকা পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিচার হয়। এদের বেতন ভাতা ইনক্রিমেন্ট বন্ধ হয়ে যায়, বরখাস্তও হতে পারে। তবে তাদের শাস্তি অবশ্যই হয়ে থাকে পুলিশের কানুনের মধ্যে।
পুলিশের বিরুদ্ধে অনেক গাফিলতির অভিযোগ সাধারণ মানুষের। তারা বিচারও পান না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অনেক বিচার হয়, অনেক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। একমাত্র এই বাহিনীর সদস্যদের যত বিচার হয়, অন্য কোনো সংস্থার সদস্যদের সেই বিচার হয় না বললেই চলে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, কোনো আসামি যদি পুলিশ হেফাজতে থাকেন, তাকে পুলিশ সদস্যরা কিভাবে রাখেন এবং তার খোঁজ-খবর কিভাবে নেন, সেই বিষয়টি মূলত অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। তার সঙ্গে পুলিশের আচরণটা কেমন হবে বা হচ্ছে- সেটা অনেকটা ভাবার বিষয়। এমনিতেই পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ অনেক ধরনের অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগ তো একদিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে এসব অভিযোগ তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া পুলিশ সদস্যরা যদি কাউকে গ্রেপ্তার করেন, তাকে একটি মামলা দেয় এবং মিথ্যা মামলা দেওয়ার হুমকি দেয়। এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। অনেক সময় দেখা গেছে, পরিবার বাধ্য হয়ে মিথ্যা মামলা থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য পুলিশকে টাকা দেয়। অর্থাৎ এটি স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। যার কারণে এই ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয় এবং পুলিশ বিতর্কিত হয়।
তিনি বলেন, আসামি গ্রেপ্তারের পর থানায় তাকে ২৪ ঘণ্টার বেশি রাখার কোনো সুযোগ নেই। যদি থানায় ২৪ ঘণ্টার বেশি রাখা হয় তাহলে এটি অপরাধ। অনেক ক্ষেত্রে আসামিরা ২৪ ঘণ্টার বেশি থাকে, সেটারও অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া একজন আসামিকে থানার যে জায়গাটায় রাখা হয় সেটি ভালোভাবে দেখে নেওয়া এবং ওই আসামির উপর নজর রাখা। মাঝেমাঝে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়া এ সব পুলিশের আইনেও রয়েছে, তবে অনেক ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন হয় না। দেখা গেছে, অনেক আসামি গ্রেপ্তারের পর শুধু খাবারের সময় তার খোঁজখবর নেওয়া হয়। যার কারণে অনেক সময় আসামিরা হতাশ থাকে এবং তারা আত্মহত্যা বা অন্যান্য দুর্ঘটনার পথ বেছে নেয়। পুলিশ যদি আসামিদের নজরে রাখে তাহলে আত্মহত্যা বা অন্য কোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে। আমাদের দেশের পুলিশ অনেক সময় তাদের দায়িত্ব অবহেলা করে যার কারণে এ সমস্ত দুর্ঘটনা ঘটে এবং পুলিশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
তৌহিদুল হক আরও বলেন, যে ব্যক্তি আইনের হেফাজতে মারা যায় তার পরিবারের বক্তব্য খেয়াল করলে দেখা যাবে, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। বা থানা পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু একটা চাওয়া হয়েছে, যেটা স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। এমনকি হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়েছে। হেফাজতে মারা যাওয়ার পর সেই পরিবার ওই সমস্ত হুমকি-ধামকি গণমাধ্যমের সামনে বা সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরেন। তখন পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠে আসে। আবার অনেক সময় দেখা গেছে, মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে সাধারণ মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন বা তারা বিভিন্ন আন্দোলন করছেন। সাধারণ মানুষ এ বিষয়টিকে সত্য হিসেবে মেনে নেয় এবং তারা পুলিশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
তিনি বলেন, পুলিশ যদি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে না পারে এবং সেবা দিতে অক্ষমতার পরিচয় দেয় তাহলে এর দায়ভার পুলিশকে নিতে হবে। এসব বিষয়ে পুলিশকে সতর্ক থেকে আসামিদের খেয়াল রাখতে হবে এবং বিভিন্ন স্বার্থ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই সংস্থাকে বের হয়ে আসতে হবে। তবেই এই সংকট অনেকটা নিরসন হবে।
এনএইচবি/আরএ/