যে কারণে হুন্ডির প্রতি ঝোঁক প্রবাসীদের
সরকার বলছে হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধপথে দেশে টাকা আনা বন্ধ করতে। এ জন্য সরকার প্রণোদনাও দিয়েছে আড়াই শতাংশ। কিন্তু বৈধপথে দেশে টাকা পাঠাতে গেলে নানান ঝক্কিঝামেলার কারণে নিরুৎসাহিত হন প্রবাসীরা। তার উপর আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরতদের অসহযোগিতা।
এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক বাংলাদেশি আছেন যাদের বৈধ কাগজপত্রের (আকামা) মেয়াদ শেষ হেয়েছে। তারা সেসব দেশে অবৈধ উপায়ে কাজ করে যে আয় করেন সেই অর্থ বাধ্য হয়ে তাদের হুন্ডির মাধ্যমেই পাঠাতে হচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে অর্থ পাঠানোর সুযোগ তাদের সামনে থাকে না।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ওয়েবসাইটের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন এক কোটি ৩৩ লাখের বেশি লোক। এরমধ্যে সৌদি আরব প্রবাসী হচ্ছেন প্রায় ৩৩ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৮ শতাংশ, ওমানে প্রায় ১২ শতাংশ। বিশ্বের কমপক্ষে ১৬৮টি দেশ বসবাসকারী বাংলাদেশিরা এই সময়ে দেশে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৩৮ মিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন। তারমধ্যে ২০ শতাংশ রেমিট্যান্স এসেছে সৌদি আরব থেকে, ইউএসএ থেকে ১৬ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১২ শতাংশ, যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ১১ শতাংশ। বাকি রেমিট্যান্স বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থেকে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আর দেশে আসা রেমিট্যান্স বড় অংশই এসেছে ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বিভিন্নভাবে তাদের সহায়তা করার কথা বললেও বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জরিপ বলছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের ৬২ শতাংশ অদক্ষ ও ৩৬ শতাংশ আধা দক্ষ। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি শ্রমিক আছেন। এই অদক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিকরা অনেকে ভিটেমাটি বিক্রি করে জীবন বদলের আশায় বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু বৈধ কাগজপত্র না থাকায় অনেকেই দালালের খপ্পড়ে পড়ে। অনেকে আবার বৈধপথে গেলেও আকামার (বৈধ কাগজপত্র) মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় পড়েছেন বিপাকে। তারা বিভিন্ন কারণে আকামা নবায়ন করতে পারছেন না।
ফলে যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই তারা বাধ্য হয়ে লুকিয়ে বা গোপনে কাজ করে আয় করছেন। কিন্তু সেই অর্থ বৈধপথে পাঠাতে পারছে না। তাই তাদের হুন্ডির মাধ্যমেই দেশে স্বজনের কাছে টাকা পাঠাতে হয়। হুন্ডির মাধ্যমে আসায় তারা বেশি রেট পান।
এদিকে অনেকে বৈধপথে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠালেও ব্যাংক থেকে তার স্বজনের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হয় না। প্রবাসীরা ফোন করে জানার পর তারা ব্যাংকে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় কাউন্টারে। এই টাকা পেলেও তা হুন্ডির রেটের চেয়ে অনেক কম। তাই সরকার রেমিট্যান্সে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করলেও তাতে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না প্রবাসীরা।
সৌদিপ্রবাসী এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘কোম্পানি ও ব্যক্তিগত আকামায় (কাজ করার অনুমতি) আমরা এ দেশে আসি। কিন্তু মেয়াদ শেষ হলেও দুতাবাসের কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না। অনেকে কফিলের প্রতারণা শিকার হন। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রবাসীরা প্রতারণার শিকার হয়ে থাকি। আকামার মেয়াদ শেষ হওয়ায় বাধ্য হয়ে গোপনে কাজ করে থাকি। কিন্তু রেসিডেন্সিয়াল কার্ড (আইডি) না থাকায় ব্যাংকে যাওয়া যায় না। দেশে টাকা পাঠাতে হলে ব্যাংকে আইডি কার্ড লাগে। সেটি না থাকায় বাধ্য হয়েই হুন্ডির মাধ্যমেই টাকা পাঠাতে হয়। কিন্তু তাতে দেশে ডলার যায় না। তারপরও বেশি দর পাওয়া যায়।’
ইতালি প্রবাসী অপর একজনও জানান একই কথা। দূতাবাসের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা ভিটেমাটি বিক্রি করে বিদেশে আসলেও বিপদে পড়লে কাউকে পাওয়া যায় না। দূতাবাসের কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে যা আয় করি সেই টাকা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে পাঠাই। কিন্তু আমরা ডলার না দিলেও তার সমপরিমান অর্থ টাকায় হিসাব করে বাড়িতে অতি সহজে পৌঁছে যায়।
প্রবাসীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহিনের সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা যোগাযোগ করলে তিনি প্রথমে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে কথা বলতে না চাইলেও পরে এসএমএস এর মাধ্যমে জবাব দেন। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যাওয়া অনেককর্মী ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন- এটা বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নয়। কখনো কোনো কর্মী ভোগান্তির শিকার হলে এবং তা সংশ্লিষ্ট দেশের আমাদের মিশনকে জানালে বা মিশন কোনো সোর্স থেকে জানতে পারলে তার সুরাহা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। অভিযুক্তের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বর্তমানে রেমিট্যান্সের ওপর আড়াই শতাংশ প্রনোদনা দেওয়াসহ বৈধ চ্যানেলকে আরও আকর্ষণীয় করা হয়েছে। বৈধ চ্যানেলকে আরও সহজ ও আকর্ষণীয় করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়া সহজ করেছে। প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণে উৎসাহিত করার জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে।‘
এদিকে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে আসে রেমিট্যান্স। কিন্তু তা পেতে হয়রানির শিকার হন প্রবাসীদের কাছের মানুষ। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এর চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘এটা এখন আলোচিত ইস্যু। তাই এই ব্যাপারে আমি কোনো কথা বলব না।’ পরে কিন্তু এবিবির বর্তমান বা সাবেক কোনো কর্মকর্তাই এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
প্রবাসীদের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘দেখেন, সাম্প্রতিক সময় থেকে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের সংকট চলছে। তাই ব্যাংকগুলোকে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ (রেমিট্যান্স) যাতে দ্রুত তাদের আপনজন পেয়ে যান। কোনো প্রকারের হয়রানি করা চলবে না। তারপরও যদি কোনো ব্যাংক হয়রানি করে অভিয়োগ পেলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে নিজেদের ডলার দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটাতে।‘
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন দূতাবাসে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আছেন। তাদের দায়িত্ব প্রবাসীদের সহায়তা করা। প্রবাসীদের সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সংযুক্ত করার প্রয়োজন মনে করছি না। সব কাজের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক না। যার যে কাজ তাকে সেই কাজ করতে হবে। প্রবাসীদের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সঠিকভাবে, দায়িত্বশীলভাবে কাজ করলে তারা উপকৃত হবেন। প্রবাসীদেরও সচেতন হতে হবে। ডিজিটাল যুগে সব তথ্য পাওয়া খুব সহজ। তাই তাদের প্রয়োজনে আরও তৎপর হতে হবে প্রবাসীদের।’
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত এপ্রিল থেকে আমদানি ব্যয় খুবই বেড়ে গেছে। কিন্তু রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স সেভাবে আসছে না। অপরদিকে সৌদিআবরসহ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ প্রবাসীরা বৈধ কাগজপত্রসহ বিভিন্ন জটিলতার জন্য ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন না। তারা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। তাদের পাঠানো ডলারের বিনিময় হার বেশি ধরে দেশে টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাস থেকে অদক্ষ ও আধাদক্ষ শ্রমিকরা সমস্যায় পড়লেও তেমন সহায়তা পান না। বাধ্য হয়ে তারা কষ্টের অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে অল্প সময়েই স্বজনের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এতে রেটও বেশি পাচ্ছেন। তাই ব্যাংকমুখী করতে দূতাবাসগেুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করা হলে ব্যাংকিং সুবিধা বাড়বে। তাহলে বৈধপথে দেশে রেমিট্যান্স আসবে।
তারা আরও জানান, সম্প্রতি সময়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনও অনেক বেড়ে গেছে। তাই কিছু সময়ের জন্য ক্যাশ আউট নিয়ন্ত্রণও করা দরকার। তাহলে হুন্ডির রমরমা কারবার অনেক কমে যাবে।
এনএইচবি/এসএন