বিশেষ প্রতিবেদন
তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরানো হচ্ছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল
মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুরাতন হাইকোর্ট ভবন থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেজন্য এ ভবন সংলগ্ন খালি জায়গায় ইতোমধ্যে টিনশেড স্থাপনা প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে এই বিষয়ে ‘তীব্র প্রতিবাদ’ জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিগণ, ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার দপ্তরের সব লোকবল, তদন্ত সংস্থার সমন্বয় দপ্তরসহ সব দপ্তরের কার্যক্রম পরিচালিত হবে নবনির্মিত এই স্থাপনায়। এক কথায় পুরোনো ভবনে আর কোন লোকবল থাকবে না। প্রসিকিউটরগণসহ চিফ প্রসিকিউটর দপ্তরের লোকবল এরমধ্যে নতুন স্থাপনায় দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু করেছেন।
জানা গেছে, নতুন টিনশেড স্থাপনায় ট্রাইব্যুনালের বর্তমান এজলাসের আদলে আরেকটি এজলাস ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন এই টিনশেড স্থাপনা তৈরি হচ্ছে।
নতুন স্থাপনা বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের (ডিভিশন -৪) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহাবুবুর রহমান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। চাইলে সেখানে কাজ শুরু করা যাবে। এরমধ্যে প্রসিকিউশন সেখানে দাপ্তরিক কাজ শুরু করেছে।’
ট্রাইব্যুনালের ডেপুটি রেজিস্ট্রার অমিত কুমার দে ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘গণপূর্ত অধিদপ্তরকে আমরা বলেছি, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ভবন থেকে সরতে চাচ্ছি।’
তাড়াতাড়ি কেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি একটি পরিত্যক্ত ঘোষিত ভবন। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ভবন থেকে সরে যেতে হবে। সরকারও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।’
বিষয়টি নজরে আনলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ’আমাদের বক্তব্য খুব পরিষ্কার। আমরা যেটি প্রথম থেকে বলে আসছি যে, আমাদের এই ট্রাইব্যুনালটি যেনতেন একটি ট্রাইব্যুনাল নয়… (সংযুক্ত অডিওতে সম্পূর্ণ বক্তব্য)’।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি বিশাল ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছে এই বিচারের আয়োজন করে। পৃথিবীর সামনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যে, আমাদের সীমিত সুযোগ, সীমিত রশদ নিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করতে পারছি। এই ভবনটির একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে।’
তিনি বলেন, ‘নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালকে যেমন জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে, আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও বিচার শেষে জাদুঘরে রূপান্তর করা হোক। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালও একটা ঐতিহাসিক ভবনে হয়েছিল।’
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে অবসরে যাওয়া বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘আমরা আগে এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করেছি। এখনও করব। এটি (পুরাতন হাইকোর্ট ভবন) একটি ঐতিহাসিক জায়গা হয়ে গেছে।’
ট্রাইব্যুনাল সরানোর উদ্যোগ আগেও নেওয়া হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গ টেনে নির্মূল কমিটির শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) বলেন, ’ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আগেও আপত্তি ছিল, এখনও আপত্তি করবে। আমি আলাপ করব ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সদস্যদের সঙ্গে।’
পূর্বের প্রসঙ্গ টেনে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমরা তীব্র প্রতিবাদ করছি। ভবনের কোন অংশের মেরামত করার দরকার হলে সেটি করা হোক এবং বিচারটি এই ভবনেই করা হোক। কোনভাবেই এখান থেকে সরানো উচিৎ হবে বলে আমরা মনে করি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিচারপতি সিন্হা (সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিন্হা) এ রকম একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন আমরা বলেছিলাম, ট্রাইব্যুনাল সরাতে হলে আমাদের লাশের উপর দিয়ে সরাতে হবে।’
প্রসঙ্গত, এর আগে একবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুরাতন হাইকোর্ট ভবন থেকে সরাতে বলেছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। তবে সেজন্য ভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছিল।
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিন্হা প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে সর্বোচ্চ আদালত এলাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। উচ্চ আদালতে বিচারকদের স্থান সংকুলান করার উদ্দেশ্য উল্লেখ করে চিঠিতে ওই বছর ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের পুরোনো ভবনটি হস্তান্তর করার জন্য 'নির্দেশক্রমে অনুরোধ' করা হয়।’
চিঠিতে বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীর মধ্যে মৌখিক আলোচনার উল্লেখ ছিল। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আলাপ-আলোচনা করে ট্রাইব্যুনাল স্থানান্তরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
'বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অনুকূলে পুরোনো হাইকোর্ট ভবনের দখল হস্তান্তর প্রসঙ্গে' শিরোনামে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘সুপ্রিম কোর্টে পর্যাপ্ত স্থানাভাবে বিচারপতিদের প্রয়োজনীয় চেম্বার ও এজলাসের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া স্থান সংকুলান না হওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক চেম্বার/অফিসের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘ভবিষ্যতে বিষয়টি আরও প্রকট হবে। জরুরি ভিত্তিতে এ সমস্যা দূর করতে পুরাতন হাইকোর্ট ভবন (ট্রাইব্যুনাল) সুপ্রিম কোর্টের বুঝে পাওয়া একান্ত অপরিহার্য।’
চিঠি দেওয়ার কয়েকদিন পর ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট যুদ্ধাপরাধের বিচার বিলম্বিত করতে জামায়াতে ইসলামী নানা কৌশল নিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নেওয়ার চিঠি তাদের ‘ষড়যন্ত্রের’ ফসল। সেজন্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিন্হাকে দোষ দিয়েছিলেন শাহরিয়ার কবির। তখন একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে অবসরে যাওয়া বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং সংস্কৃতি সংগঠক কামাল লোহানী।
ওই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে শাহরিয়ার কবির বলেছিলেন, ‘জামায়াতের একটি কৌশল হচ্ছে যতভাবে এটিকে (যুদ্ধাপরাধীদের বিচার) বিলম্বিত করা যায়। এর কারণ হচ্ছে জামায়াত আশা করছে, যে কোন সময় একটি ‘মিরাকল’ ঘটবে, সরকারের পতন ঘটবে এবং যারা জেলখানায় আছে তারা বেরিয়ে আসবে। এই কৌশল নিয়ে জামায়াত এগোচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ আমাদের কাছে অত্যন্ত ক্ষোভের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নিতে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে দেওয়া চিঠি।’
সম্মেলনে অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট সড়ক ভবনের যে জায়গাটি নিয়েছে তার আয়তন সুপ্রিম কোর্ট নতুন ভবনের আয়তনের প্রায় সমান। বিচারের এজলাস বসার জায়গা নেই বলে এটি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে এখন সেলুন, বিউটি পার্লার, জিমনেসিয়াম, ব্যাঙ্কোয়েট হল ও থাকার জায়গা। তাহলে আমাদের ধরে নিতে হবে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের চেয়ে বিউটি পার্লার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটিই যদি ধারণা দেওয়া হয় তাহলে এর থেকে লজ্জার ও দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে আর কিছু হতে পারে না।’
ওই চিঠি দেয়ার মাস কয়েক পর ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এর শেষ অবস্থা আমি বলতে পারব না। যতবার আদেশ পাব, ততবার আমি এটি পুনর্বিবেচনা করার জন্য বলব। সুপ্রিম কোর্ট যতবার চিঠি দেবে, ততবার আমি পুনর্বিবেচনার জন্য চিঠি দেব।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমাতায় আসার পরের বছর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ হাইকোর্ট মাজার সংলগ্ন পুরোনো হাইকোর্ট ভবনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়। ওই ভবনে আইন কমিশন ও জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের অফিস ছিল।
এমএ/এএন