মুনাফালোভীদের আগ্রাসনে অস্থির চালের বাজার
গত কিছু দিন ধরে অস্থির চালের বাজারের লাগাম টেনে ধরতে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ১০ লাখ টন পরিমাণ খাদ্য শস্য আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ‘ফ্যামিলি কার্ডের’ মাধ্যমে আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুলভমূল্যে চাল বিক্রি করা হবে। ফ্যামিলি কার্ডের সংখ্যা বাড়ানোর প্রক্রিয়াও চলছে। গত বছর এই সময়ে খাদ্যশস্য মজুদ ছিল ১৬ লাখ ৬৯ হাজার মেট্রিক টন। এবার তার চাইতে বেশি মজুদ থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়িয়ে বাজারকে অস্থির করে তুলছেন মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা।
এর মধ্য দিয়ে বাজারের অস্থিরতার লাগাম টেনে ধরা হবে। চাল আমদানির বিষয়ে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করেছে সরকার। আরও একাধিক দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
ঠুনকো অযুহাতে যেন বাজার অস্থিতিশীল না হয় সেদিকে নজর দিতে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী ইতোমধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয় চালের বাজারে মনিটরিং জোরদার করেছে। প্রায় প্রতিদিনই চালের বাজার মনিটরিং করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে অভিযান চালানো হচ্ছে। একইসঙ্গে ভোক্তা অধিকারও অভিযান পরিচালনা করছে জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেছেন, বর্তমান অবস্থায় চালের দাম আর বাড়বে না।
এদিকে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে সরকার আগামী ১ সেপ্টম্বর থেকে ব্যাপক আকারে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু করতে যাচ্ছে। সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ থেকে ৫০ হাজার পরিবারকে কার্ডের মাধ্যমে কম মূল্যে চাল দেবে সরকার। ১৫ টাকা কেজি দরে এই চাল দেওয়া হবে। এই ফ্যামিলি কার্ডের সংখ্যা দেড় লাখে উন্নীত করার জন্য কাজ চলছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে পরিবার প্রতি ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে ১৫ টাকা কেজি দরে। এই কার্যক্রম চলবে তিন মাসব্যাপী। পাশাপাশি খোলা বাজারেও (ওএমএস) ৩০ টাকা দরে ৫ কেজি করে চাল বিক্রি করা হবে। সারাদেশে উপজেলা পর্যায়ে দুই হাজার ১৩ জন ডিলারের মাধ্যমে ওএমএস কর্মসূচি চলবে।
সরকারের নীতি নির্ধারকরা মনে করছেন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু হলে প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি মানুষ কম মূল্যের চালের আওতায় আসবে। তাতে বাজারে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিপুল এই সংখ্যক লোক যখন কম টাকায় চাল পাবে তখন বাজারে মোটা চালের দোকানে ভিড় কমবে। বাজারে অস্থিরতাও কাটবে।
খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি এবং ওএমএস ছাড়াও সরকার মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধ করতে বাজারে পর্যাপ্ত খাদ্য শস্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। যাতে কোনো অযুহাতেই মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা বাজারকে যেন জিম্মি করতে না পারে। এজন্য সরকার ভারত, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়া থেকে খাদ্যশস্য আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
এরইমধ্যে ভিয়েতনামের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ভারতের সঙ্গেও চুক্তির আওতায় চাল আমদানি শুরু হয়েছে। ভারত থেকে আগামী মাসে ৫০ হাজার টন ও অক্টোবরে আরও ৫০ হাজার টন চাল আসবে। ভারত থেকে আমদানিকৃত চালের ৭০ ভাগই আসবে জাহাজে। বাকি ৩০ ভাগ আসবে রেলপথে। নদী পথে চাল আমদানিতে প্রতি মেট্রিক টনে খরচ হবে ৩৪৩ দশমিক ৫ ডলার। অর্থাৎ কেজি প্রতি খরচ হবে ৩৪ টাকা ৩০ পয়সা।
অন্যদিকে, ট্রেনে প্রতি টন আমদানিতে খরচ হবে ১৮ ডলারের কম। ট্রেনে আমদানি খরচ কম হলেও ধারণ ক্ষমতা কম থাকায় সেটি আনা সম্ভব হচ্ছে না।
মজুদের অবস্থা
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২৩ আগস্ট পর্যন্ত দেশে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ ১৯ লাখ ৮১ হাজার ৮৮ মেট্রিক টন। এরমধ্যে ধান এক লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন, চাল ১৬ লাখ ৮৫ হাজার ৫২৩ মেট্রিক টন। গম এক লাখ ৪৫ হাজার ১৯০ মেট্রিক টন। গত বছর এই সময়ে খাদ্যশস্য মজুদ ছিল ১৬ লাখ ৬৯ হাজার মেট্রিক টন। এবার তার চাইতে বেশি মজুদ থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়িয়ে বাজারকে অস্থির করে তুলছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিদ্যমান গুদামে ধারণ ক্ষমতা ২১ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে যে পরিমাণ খাদ্য মজুদ রয়েছে তাতে ধারণ ক্ষমতার প্রায় কাছাকাছি। এখনও সংগ্রহ চলছে।
বর্তমানে মিলগেটে মোটা চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪১ টাকা ২৫ পয়সা। বাজারে সেই চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা কেজি দরে। কেজিতে প্রায় ১৪ টাকা বাড়তি নিচ্ছে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। এটা অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন খরচ যেটা বেড়েছে তাতে কেজি প্রতি ১ টাকা বেশি বাড়ার কথা না। তারপরও কেন এত দাম বৃদ্ধি, এ নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী ও মিল মালিকদের মধ্যে বিতন্ডা হয়েছে বলে জানা গেছে। মিল মালিকরা বলেছেন, খুচরা ব্যবসায়ীরা কেজিতে অতিরিক্ত মুনাফা নিতেই এমনটি করছেন।
চালের দাম কেজিতে ১৩ টাকা থেকে ১৪ টাকা বৃদ্ধি পাওয়া কতোটা যৌক্তিক জানতেই চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বুধবার (২৪ আগস্ট) ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ’জ্বালানি তেলের দামের হিসাব যদি করা যায় তাহলে প্রতি কেজিতে ৫০ পয়সা বাড়তি হতে পারে। খুব বেশি হলে ১ টাকা বাড়তি হতে পারে; এর বেশি বাড়তি হওয়ার কোনো কারণ নাই।’
খাদ্যশস্য আমদানি করা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘প্রক্রিয়া চলছে। তা ছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির জন্য ট্যাক্স কমানো হয়েছে। যেটা ১৫ শতাংশ ছিল সেটা ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে। এ বিষয়ে আজ-কালকের মধ্যে এসআরও জারি হবে। এই মুহূর্তে যা আছে তাতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা খড়ার কারণে ভবিষ্যতে যেন সমস্যা না হয় তার জন্য খাদ্য নিরাপত্তার চিন্তা করে আমদানি করছি।’
এনএইচবি/আরএ/