অনিশ্চয়তায় ৫ হাজার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ
বাংলাদেশে একেবারে ব্যতিক্রমী খাত ‘পরচুলা’ তৈরি ও রপ্তানি করে রেকর্ড করেছে এভারগ্রিন প্রোডাক্ট ফ্যাক্টরি (বিডি) লিমিটেড। এভারগ্রিন নামে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে গড়ে তুলেছেন ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানি লিমিটেড, মাস্টার পার্পেল লিমিটেডসহ আরও ১৭টি প্রতিষ্ঠান। এ সব প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চ্যাং ই চং ফিলিক্স (Chang Yoe Chong Felix) নামে এক চীনা বিনিয়োগকারী। এ খাতে তিনি পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগেরও রেকর্ড করেছেন। চীন থেকে কাঁচামাল এনে নীলফামারী উত্তরা ইপিজেটে শতভাগ কমপ্লায়েন্স মেনে সুনামের সঙ্গে আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই প্রতিষ্ঠানের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
কিন্তু এই কোম্পানির শিপিং ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক শামিম উদ্দিনের যোগসাজশে কোম্পানির নামে মদের চালান আসে বাংলাদেশে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক চ্যাং ই চং ফিলিক্স কিছু না জানলেও চট্টগ্রাম বন্দর থানায় তাকে আসামি করে একটি মামলা হয়েছে। এতে অনিশ্চয়তায় পড়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ।
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে এভারগ্রিন প্রোডাক্ট ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেন চীনের এক বিনিয়োগকারী। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হচ্ছেন মি. চ্যাং ই চং। পরবর্তীতে নীলফামারীতে উত্তরা ইপিজেডে ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানি লিমিটেডসহ আরও অনেকগুলো কোম্পানি গড়ে তোলেন এই বিদেশি বিনিয়োগকারী।
নীলফামারী জেলার উত্তরা ইপিজেডে চীনের বিনিয়োগকারী ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানি গড়ে তুলে পরচুলা তৈরি করে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। আশেপাশের কয়েক জেলার প্রায় ৪০ হাজার বেকার নারী-পুরুষ এখানে কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
উত্তরা ইপিজেডে ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানি পরচুলা বিদেশে রপ্তানি করে দেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। এই পরচুলা আমেরিকা, আফ্রিকা, চীন, কানাডা, জাপান, ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। ডং জিন কোম্পানিতে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত শ্রমিকরা কাজ করেন।
সরজমিনে গেলে কর্মীরা ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, ডং জিন কোম্পানিতে আমরা পরচুলা তৈরি করে থাকি। ছোট-বড় দুই ধরনের পরচুলা এখানে তৈরি করি আমরা। ছোট ক্যাপটি একদিন থেকে দেড় দিনে আর বড় ক্যাপটি দুই থেকে তিনদিন পর্যন্ত তৈরি করতে সময় লাগে। তারা আরও বলেন, এখানে কাজ করে আমরা সবাই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছি। এখানে কাজ করে সংসারের খরচের পাশাপাশি সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে শিক্ষিত করে তুলছি।
উত্তরা ইপিজেডের অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক (এইডি) ফেরদৌস রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এভারগ্রিনের একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ডং জিন। এখানে শুধুমাত্র পরচুলা উৎপাদিত হয়। সেইসব পরচুলা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে থাকে কোম্পানিটি।
সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় হচ্ছে ঢাকার গুলশান ১ নম্বরে, রোড নম্বর ৮, বাসা নম্বর ১৫। বিদেশ থেকে কাঁচামাল এনে একে একে ১৭টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশে। যা এ খাতে রেকর্ড। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪০ হাজার লোক কর্মরত। এর প্রায় ৯৫ ভাগ কর্মী বাংলাদেশের।
তবে এ সব প্রতিষ্ঠানের প্রায় কাঁচামাল চীন থেকেই আমদানি করা হয়। পরচুলা তৈরি করে তা রপ্তানি করা হয়। এই আমদানি-রপ্তানি কাজের জন্য শিপিং ডিপার্টমেন্ট এর মহাব্যবস্থাপক হিসেবে মো. শামিম উদ্দিনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনিই যখন যা দরকার আমদানি-রপ্তানির ব্যবস্থা করে থাকেন। এই কাজের জন্য তিনি ইমপোর্টার রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (আইআরসি) ব্যবহার করেন। প্রোফরমা ইনভয়েস (পিআই) অনুযায়ী চাহিদা মোতাবেক আমদানি-রপ্তানির ব্যবস্থাও করেন।
সূত্র মতে জানা যায়, ওই মদের চালানটি ধরা পরে কিছু অরিজিনাল ডকুমেন্টসের অভাবে, যার অন্যতম হলো আইআরসি (IRC)। উক্ত আইআরসি টি সঠিক সময়ে নবায়ন করা যায়নি বলে মদের চালানটি ধরা পরে। মদের চালানটি ধরা পড়ার আগে ব্যবস্থাপক শামীম উদ্দিন আইআরসিটি নবায়ন করার জন্যে অনেক চেষ্টা করেন। তখন কোরবানি ঈদ উপলক্ষে সরকারি অফিস বন্ধ হয়ে যায়— তাই এই ডকুমেন্টসটির অভাবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে মদের চালানটি ধরা পরে।
যখন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেলিক্স চীন ভ্রমণে যান ঠিক এই সুযোগ নিয়ে প্রতারক চক্রটি চীনের রপ্তানিকারকের সঙ্গে যোগসাজশ করে ১৮ হাজার ৭০০ কেজি র মেটিরিয়াল পলিস্টার রেসিনের (raw materials polyester resin) স্থলে ১৬ হাজার ৭২৫ লিটার মদ আনার চেষ্টা করে। আইআরসির মেয়াদ না থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরে গত ২৪ জুলাই চেক করে কায়িক পরীক্ষায় ধরে পড়ে বলে কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান। অসত্য ঘোষণা এবং আইপিও ২০২১-২৪ এ শর্ত ভঙ্গ করে আমদানি করার অভিযোগে চট্টগ্রাম কমিশনার অব কাস্টমস হাউসের পক্ষে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. ওয়াহিদুজ্জামান গত ১ আগস্ট মামলা করেন। এই তথ্য জানার পর কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক একবারে হতবাগ হয়ে যান। কারণ ওই সময়ে তিনি বাংলাদেশে ছিলেন না, ছিলেন চীনে। তার নামে মামলা হওয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশে আসতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক শামিম উদ্দিন সুযোগ পেয়ে রপ্তানিকারকের সঙ্গে যোগসাজশ করে এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। কারণ পিআইতে পণ্যের পরিমাণ, মূল্যসহ সব কিছু উল্লেখ করা থাকে। প্রতিষ্ঠিত কোনো কোম্পানি ঘোষণাকৃত পণ্যের বাইরে কিছু করে না।
কিভাবে এটা সম্ভব তা জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, রপ্তানিকারকের সঙ্গে আলোচনা করে সব ডকুমেন্ট দিয়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে এলসি ওপেন করেন। পিআইতে তা উল্লেখ থাকে। তার বাইরে কিছু আনার সুযোগ নেই। রপ্তানিকারকের (যে প্রতিষ্ঠান পণ্য পাঠিয়েছে) যোগসাজশ ছাড়া কোনো কোম্পানির নামে পিআই‘র পণ্য না দিয়ে অন্য কোনো পণ্য দেওয়া সম্ভব না। কাস্টমস অফিস থেকে চেক করলে তা ধরাও পড়ে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও জানান, কোনো বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে তাকে যথাযথভাবে নিয়ম-কানুন মেনেই করতে হয়। চীনের এই কোম্পানিও তার বাইরে নয়। রেজিস্ট্রেশনের পর বিডা থেকে আইআরসির জন্য সুপারিশ করা হয় কি পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবে তা উল্লেখ করে। পরে বিনিয়োগের পরিমাণ কমানো বা বাড়ানো হলেও তা সংশোধন করা হয়। আইআরসির নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হলে তা নবায়ন করা হয়। কাজেই কোনো প্রতিষ্ঠান এক পণ্যের নামে অন্য পণ্য আনলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যোগসাজসেই তা হয়ে থাকে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ছাড়া এভাবে পিআই’র বাইরে কোনো পণ্য দেশে আসার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এ দেশের ব্যাংক সব ডকুমেন্ট নিয়েই এলসির স্বীকৃতি দেয়। ওই (রপ্তানিকারক) দেশের ব্যাংক মার্জিন অনুযায়ী তা গ্রহণ করে এবং রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আমদানিকারকের কাছে পৌঁছার ব্যবস্থা করে। তবে অনেক সময় তিনি অন্য কোনো পণ্যও দিয়ে থাকেন। কাস্টমস অফিস থেকে চেক করলে তা ধরা পড়ে। না পড়লে তা পৌঁছে যায় দেশে।’
অভিযোগ অস্বীকার করে কোম্পানিটির মহাব্যবস্থাপক শামিম উদ্দিন জানান, মামলাটি কেন হয়েছে তা আমার কাছে বোধগম্য না। আমার অজান্তে যেখানে যা সই স্বাক্ষর লাগে তা জাল করা হয়েছে। কারণ কাস্টমস অথরাইজেশনে আমি যেভাবে ইনভয়েস সংক্রান্ত কাজ করে থাকি এখানে সেভাবে হয়নি। ব্যাপারটি খতিয়ে দেখার জন্য এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
জেডএ/আরএ/