আন্দোলন প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত বিএনপি নেতৃত্ব
আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত বিএনপি নেতৃত্ব। একপক্ষ চায় এখনই সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু করতে। অপরপক্ষ ‘ধীরে চল নীতিতে’ আগাতে চায়। আন্দোলন প্রশ্নে নেতৃত্বের এই দ্বিধাবিভক্তি বিএনপির ভেতরে-বাইরে অনেকটাই ‘ওপেন সিক্রেট’।
বিএনপির বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে আলাপকালে এমন ইঙ্গিতই পাওয়া গেছে।
দলটির শীর্ষ নেতাদের একটি পক্ষ এখনই চূড়ান্ত আন্দোলনের পথে হাঁটতে চাচ্ছেন। অপর একটি পক্ষে অবস্থান করা নেতারা আরও কিছুটা সময় নিয়ে রাজপথের চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার বিষয়ে মতামত তুলে ধরছেন। সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির সভায় এ নিয়ে উভয়পক্ষ আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।
সম্প্রতি যুবদলের সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘আমাদের সীমানা আটকে গেছে, প্রেসক্লাব-বিএনপি অফিস। আমাদের মিছিল, হরতাল অবরোধে যেতে হবে।
একই অনুষ্ঠানে স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, কর্মসূচিতে আমরা যদি হার্ড লাইনে না যাই; সরকার সরকারের জায়গায় থাকবে। আমরা জনসভা করব, অগণিত মামলায় জর্জরিত হব। কিন্তু সরকার পতন ঘটাতে পারব না।’
তাদের এ ধরনের বক্তব্যে সমাবেশে আগত নেতা-কর্মীরা হরতাল, অবরোধ কর্মসূচির দাবিতে জোর দাবি জানান। আর সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা দেন। আগামী ২২ আগস্ট থেকে সারাদেশের উপজেলা থেকে ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সেই লক্ষ্য ১০টি টিম গঠন করেছে দলটির হাইকমান্ড।
সমাবেশ শেষে রাতেই দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেই বৈঠকে আন্দোলন ইস্যুতে নেতাদের মধ্যে স্পষ্ট দ্বিধাবিভক্তি দেখা গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগে অনেক কিছু বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। সবার মত নিয়ে চূড়ান্ত হবে কঠোর কর্মসূচির কৌশল। এরপর যেটা প্রয়োজন সেটা ধাপে ধাপে চলে আসবে। আমরা হরতাল অবরোধ করি না বা করতে পারি না, তা নয়। কিন্তু যখন-তখন করব কেন? যখন করার সিদ্ধান্ত হবে তখন জানতে পারবেন।’
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘একটি সফল আন্দোলনের লক্ষ্যে আমরা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। আপাতত রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন করতে চাই। ইতোমধ্যে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়েছে। আন্দোলন নিয়ে তড়িগড়ির কিছু নেই। কারণ, যেকোনো ইস্যুতে পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি। আমরা সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। আন্দোলনের গতি কখন পরিণত রূপ নেবে সেটা পরিকল্পনায় রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আশা করি, আমাদের কর্মকাণ্ড দেখে এক সময় মানুষের আস্থা আসবে এবং তারা রাজপথের আন্দোলনে শরিক হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে নামলে সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন। অতীত ইতিহাস তাই বলে। এই মুহূর্তে আমরা সেই কাজটিই করছি। গণদাবির পক্ষে কর্মসূচি নিয়ে কেন্দ্র থেকে গ্রাম পর্যন্ত নেতা-কর্মীরা ছড়িয়ে পড়ছে। মূলত সবকিছু গুছিয়ে এনে সুযোগ বুঝে রাজপথের চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বিএনপির আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত আছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গণতান্ত্রিক দেশগুলো যাতে আমাদের পাশে থাকে এবং সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখে সেই তৎপরতাও ঠিক রাখতে হচ্ছে। সবার মত নিয়ে চূড়ান্ত হবে কঠোর কর্মসূচির কৌশল। এরপর যখন যেটা প্রয়োজন ধাপে ধাপে সেটা চলে আসবে। শেষ পর্যায়ে তা সরকার পতনের এক দফায় রূপ নেবে। আটঘাট বেঁধেই এবার চূড়ান্ত আন্দোলনে রাজপথে নামা হবে বলে জানান বিএনপির এই নেতা।
তিনি বলেন, ‘চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য আমরা নিজেরাই সংগঠিত না৷ কিভাবে সেই আন্দোলনে যাব। ঐক্যবদ্ধ না হয়ে আন্দোলনে গেলে কোনো রেজাল্ট আসে না, তা বিগত আন্দোলনে প্রমাণ হয়েছে। বরং অগোছালোভাবে হঠাৎ করে আন্দোলনে রাজপথে নামলে সরকার আমাদের গ্রেপ্তার করে এক এক করে জেলে নেবে। তাই তড়িগড়ি করে আন্দোলনে যাওয়ার চেয়ে না যাওয়াই ভালো। আন্দোলনে যেতে হলে গুছিয়ে যাওয়া উচিত। সাংগঠনিক শক্তি আরও কিছুটা মজবুত না হলে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন। এই সরকারকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে টিক, কিন্তু এমনিতে তো ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না। তাদের বিদায় করতে আন্দোলনই একমাত্র পথ।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, তর্জন-গর্জনের দরকার হবে না। গর্জন হবে কাজের মাধ্যমে। বেশি কথা বললে আন্দোলন এগিয়ে যাবে না। আন্দোলন পরিকল্পিত। তাই বক্তব্য দিয়ে শেখ হাসিনাকে সরানো যাবে না। পরিকল্পিত আন্দোলনে সরকারের পতন হবে। আমাদের কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য সুশৃঙ্খল এবং জনসম্পৃক্ততা। এই সরকারের পতন ঘটাতে হলে জনসম্পৃক্ততাকে কাজে লাগাতে হবে।
১৭ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির আন্দোলন নিয়ে জানতে চাইলে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আপনারা আন্দোলন বলতে কি শুধু হরতাল; অবরোধ বুঝেন? একটি ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে আস্তে আস্তে কীভাবে সম্পৃক্ত করে রাস্তায় নামানো যায় সেটাই হচ্ছে আন্দোলন। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। যখন তারা রাস্তা দখল করবে তখন আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি। এক দিনে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। এক দিনে আন্দোলনও হয় না। আন্দোলনের জন্য সময় লাগে। তবে আমার মনে হচ্ছে এই সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হবো এবং আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা সেই সময়ের কাছাকাছি চলে এসেছি।’
বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, গুম, খুনসহ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সোচ্চার থাকবে বিএনপি। তবে দলটি এখনই হরতাল বা অবরোধের মতো বড় কর্মসূচিতে যাবে না।
এ বিষয়ে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বিএনপির কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। যদি সরকার কথা না শোনে, তাহলে রাজপথে বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে। একদিকে দলের নীতি নির্ধারকরা আন্দোলনের কৌশলগত দিকও বিবেচনা করেছেন৷ অন্যদিকে সরকার নানাভাবে বিএনপি ও নেতা-কর্মীদের উসকানি দিচ্ছে। এরপরও আমরা সরকারের ফাঁদে পা দেব না। শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চালিয়ে জনগণকে আরও সম্পৃক্ত করা হবে। এর ধারাবাহিকতায় কঠোর আন্দোলনে দিকে অগ্রসর হবো।
প্রসঙ্গত, বিএনপির সরকার পতনে ‘এক দফা’ আন্দোলনে নামার সবশেষ ঘোষণা ছিল ২০২১ সালে। ধাপে ধাপে জনসভা ও নানা কর্মসূচি করে আন্দোলন জমানোর কথাও বলছিলেন নেতারা। বিভাগে বিভাগে জনসভার আয়োজনও করা হচ্ছিল। কিছু কিছু জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি উপেক্ষা করে জনসভা অনুষ্ঠিতও হয়। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে সব পরিকল্পনার সমাপ্তি ঘটে। বিধিনিষেধের কারণে বিএনপির পক্ষে রাজপথে কর্মসূচি দেওয়া সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার পর আবার সভা-সমাবেশ বাড়াতে থাকে দলটি। এর মধ্যে চলতি বছরের শুরুতে আবার হানা দেয় করোনার তৃতীয় ঢেউ। বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর চলে আসে রোজার ঈদ। ফলে ঈদের পর আন্দোলন; বিএনপির বারবার এই ধরনের কথাবার্তা রাজনীতিতে রসিকতা হয়ে আছে। তারপরও শীর্ষ নেতারা বারবারই বলছেন, কঠোর আন্দোলন হবে। নেতা-কর্মীরা যেন প্রস্তুত থাকেন।
এনএইচবি/এমএমএ/