বিআরটি প্রকল্প: সময়-ব্যয় বাড়ে, মানুষ মরে কাজ শেষ হয় না
বছরের পর বছর ধরে কাজ চলছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের। তবু শেষের দেখা নেই। শুধু সময় আর ব্যয় বাড়ছে। ভোগান্তিও শেষ হচ্ছে না বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত চলাচলকারী যানবাহন ও সাধারণ মানুষের।
তার উপর আবার ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ঘটছে দুর্ঘটনা। সর্বশেষ গত সোমবার (১৫ আগস্ট) নির্মাণকাজ চলাকালে ক্রেন কাত হয়ে সেগমেন্ট (বক্স গার্ডার) গিয়ে পড়ে একটি প্রাইভেট কারের উপর। তাতে প্রাণ যায় পাঁচ জনের। সেদিকেও কোনো খেয়াল নেই কর্তৃপক্ষের। তারা ব্যস্ত প্রকল্পের ব্যয়, সময় বাড়াতে আর অত্যাধুনিক অফিস কীভাবে নির্মাণ করা যায় সেই নিয়ে।
অথচ সরকার প্রধান বলছেন ব্যয় কমাতে। আর বিআরটি কর্তৃপক্ষ প্রকল্প সংশোধন করে দৃষ্টিনন্দন বিআরটি অফিস ভবন নির্মাণসহ আরও বেশ কিছু বিষয় সংযুক্ত করে সংশোধিত ডিপিপি অুনমোদনের জন্য পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।
রাজধানীবাসীকে যানজট থেকে মুক্তি ও যাতায়াত সহজ করতে সরকার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের অনুমোদন দেয় ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর। কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০১৬ সালে। কিন্তু বিভিন্ন অজুজাতে প্রকল্পের ডিপিপি এ পর্যন্ত চার দফা সংশোধন করা হয়েছে। সময় বাড়ানো হয় ২০২২ সাল পর্যন্ত। কিন্তু তাতে কাজের শেষ হয়নি। বরং সমস্যা ও ভোগান্তি বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি।
দশ বছরে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারলেও এখন আবার ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এক বছর সময় বাড়ানো হচ্ছে। এতে করে প্রকল্পের মেয়াদের পাশাপাশি ব্যয় ও ভোগান্তি বাড়বে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৮২ শতাংশ।
জানা গেছে, ২০১২ সালে যখন প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয় তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা। আর দফায় দফায় সময় বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২৬৮ কোটি টাকায়। ১০ বছরে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে দুই হাজার ২২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার ১০৯ শতাংশ।
বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও জনপথ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের তিন ভাগে তিন জন প্রকল্প পরিচালক কাজ করছেন। তাই অনেক ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ জন্য ঠিক মতো কাজ হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে বুধবার (১৭ আগস্ট) বিআরটি প্রকল্প পরিচালক এ এস এম ইলিয়াস শাহ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘এ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৮২ শতাংশ। বাকি কাজ ডিসেম্বরে হবে না। তাই সময় বাড়ানোর জন্য সংশোধন করতে হবে। পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।’
সরকার প্রধান ব্যয় কমানোর কথা বলছেন। অথচ প্রকল্পের শেষ সময়ে এসে ভবন নির্মাণের জন্য ডিপিপি সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এখন কেন এই প্রস্তাব? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মিটিংয়ে ব্যস্ত আছি, ঝামেলায় আছি বলে ফোনের সংযোগ কেটে দেন।’
প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়া সম্পর্কে ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সফিকুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, দেখেন ব্যয় বাড়ছে না। প্রকল্পের বর্তমান যে বরাদ্দ আছে সেখান থেকেই কাটছাঁট করে ভবন নির্মাণ করা হবে। এ জন্য বাড়তি কোনো খরচ হচ্ছে না। তবে প্রকল্পের সময় আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানান প্রকল্পের এমডি।
বিআরটি প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতার ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থপতি ইকবাল হাবিব ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বিআরটি প্রকল্পটির পরিণতি কি হবে তা নির্ণয় করা উচিৎ। এভাবে আর চলতে পারে না। এক দশকেও কাজটি শেষ করতে পারছে না। অব্যবস্থাপনায় ভরা। তাদের আসলে কাজে নজর নেই। জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনগণের স্বার্থে কাজ করলে এটি আগেই শেষ হয়ে যেত।’
নতুন ভবন নির্মাণের বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে ধান্দা চলছে। তাই তো শেষ সময়ে আলিশান অফিস ভবনে নজর দিয়েছে। অনেক ভবন পড়ে আছে, দরকার হলে ভাড়া নিতে পারে। সরকার ব্যয় কমাতে উদ্যোগ নিয়েছে, এমন সময়ে অফিস করার কোনো প্রশ্নই আসে না।’
তিনি বলেন, উন্নয়নের নামে রাজধানীর মহাখালি থেকে বনানী হয়ে আর্মি স্টেডিয়াম পর্যন্ত সড়ক দখল করা হয়েছে। তা ফিরিয়ে দেওয়া উচিৎ। বিভিন্ন ভবন করে নগর ধ্বংস করা হচ্ছে। তা বন্ধ করা উচিৎ।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইএর সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেছেন, ‘বিআরটি প্রকল্প আর কতকাল চলতে থাকবে। ঠিকমতো কাজ হয় না। বিমানবন্দরে ঠিকমতো যাওয়া যায় না। ঠিকমতো শিপমেন্ট করা যায় না। নিয়ম থাকলেও ঠিকাদার তা আমলে নেয় না।’
অপরদিকে প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছিল প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় রাস্তা মেরামতের প্রয়োজনীয় সংস্থান করতে হবে। একই সঙ্গে বিরামহীন যানবহন চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। এই ব্যয় প্রস্তাবিত ডিপিপিতে সংস্থানের কথাও বলা হয়। একই সঙ্গে সড়ক মেরামত ও সংস্কার কাজের সময় জনগণের যাতে দুর্ভোগ না হয় সে ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
কিন্তু এসব তোয়াক্কা করা হয়নি। কোনো প্রকারের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়াই উত্তরায় গার্ডার লাগাতে গিয়ে প্রাইভেট কারের উপর পড়লে পাঁচজন মারা যান। প্রকল্প পরিচালক এ এস এম ইলিয়াস শাহও ঠিকমতো তদারকি করেননি।
যা আছে বিআরটি প্রকল্পে
রাজধানীর যানজট নিরসনে দ্রুত গতির গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ২০১১ সালে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নির্দিষ্ট লেনে শুধুমাত্র বাস চলাচলের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর। ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পের আর্থিক সহযোগিতায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসী উন্নয়ন সংস্থা ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির ঋণ হচ্ছে এক হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। বাকি অর্থায়ন সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হবে।
প্রকল্পের বাস্তবায়ন সময় ধরা হয় ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ঋণদাতা সংস্থার সঙ্গে ২০১২ ও ২০১৩ সালে ঋণচুক্তিও হয়েছে। এরপর শুরু হয় কাজ। ডিপিপি চার দফা সংশোধন করায় ব্যয় ও সময় বাড়ে। বাড়তি ব্যয় মেটাতে অর্থমন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করতে হয়েছে ৩ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পের জন্য ১ দশমিক ৯০ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও বাস মালিকদের ক্ষতিপূরণ ছাড়াও ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ডেডিকেটেড বাস লেন, ১০ লেন বিশিষ্ট টঙ্গী সেতু, ৪ দশমিক ৫০ কিলোমিটার এলিভেটেড সড়ক, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইন্টারসেকশনে ৫৫০ মিটারের আন্ডারপাস, ৬টি ফ্লাইওভার, একটি বাস ডিপো, উভয় পাশে ১২ কিলোমিটার করে ড্রেন নির্মাণের কথা উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া যাত্রী বহনে ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস ক্রয়, ৯টি জীপ গাড়িসহ ১২টি যানবহন ক্রয়, ৪টি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতাও রয়েছে।
নতুন করে সংশোধনী প্রকল্পে ১৩০টি আর্টিকুলেটেড বাস কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের শুরুতে ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস কেনার প্রস্তাব করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) ৫ম সভায় নকশা পরিবর্তনের কারণে আবার সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে খরচ ঠিক থাকলেও সময় এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ বাবদ খরচ কমানো হয়েছে। গত মে পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি প্রায় ৭৬ শতাংশ। জুলাই পর্যন্ত ৮০ শতাংশ। বাকি কাজ এবং ডিফেক্ট ওয়ারেন্টি পিরিয়ডসহ ডিপিপি সংশোধন করে এক বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
একই সঙ্গে অন্যখাতে ব্যয় কমিয়ে প্রকল্পের একেবারে শেষ সময়ে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বিআরটি অফিস ভবন করার প্রস্তাব করা হয়েছে ডিপিপিতে।
সূত্র জানায়, বিভিন্নখাতে খরচ কম-বেশি করে শেষ সময়ে করা সংশোধিত ডিপিপিতে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সম্মতিও দিয়েছেন। সব প্রক্রিয়া শেষ করে খুব শিগগির ডিপিপি অনুমোদনের জন্য একনেক সভায় উপস্থাপন করা হবে।
প্রকল্পের মনিটরিং বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মুল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর মরিটরিং করা হয়নি। তবে নিয়ম মেনে তারা কাজ করেনি বলেই উত্তরায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। আসলে তারা কীভাবে কাজ করছে, কোথায় সমস্যা তা দেখতে মনিটরিং করা হবে।’
এনএইচবি/এমএমএ/