খাদের কিনারে মানুষ: বিপিসি ব্যস্ত লাভ আর মূলধন গড়ায়
জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেশের মানুষকে গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। গণপরিবহন থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের দাম এখন সাধারণের নাগালের বাইরে। এই সংকটের মধ্যেই মূলধনের ঘাটতি পূরণের অজুহাত দেখিয়ে জ্বালানি তেল থেকেই লাভ করতে চাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০ হাজার কোটি টাকার চলতি মূলধন গড়তে বর্তমানে প্রতি লিটার অকটেন থেকে ২৫ টাকা লাভ করছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও লাভের টাকার হিসাবে স্বচ্ছতার প্রমাণ দিতে পারছে না বিপিসি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দাম না বাড়িয়েও সংকট সামাল দেওয়া যেত। গত ৬ বছরে বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি করে যে ৪৭ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছিল সেটা দিয়ে এখনকার ভর্তুকি পুষিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারত বিপিসি। একই সঙ্গে অনেক দেশের মতো তেল আমদানিতে শূন্য শুল্ক সুবিধা দিয়ে দাম না বাড়িয়েও সংকট সামাল দেওয়া যেত। কিন্তু সরকার বা বিপিসি সেই পথে হাঁটেনি।
২০ হাজার কোটি টাকার চলতি মূলধন
বিপিসি বলছে, প্রতিষ্ঠানটির ২০ হাজার কোটি টাকা চলতি মূলধন লাগবে। এ কারণে দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। এক লাফে প্রায় ৫১ শতাংশ দাম বাড়ানোর ফলে শুধু ডিজেল-অকটেন থেকেই প্রতিমাসে ২০৫ কোটি টাকা লাভ করবে বিপিসি।
বিপিসি চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলছেন, দাম বাড়ানোর পরেও প্রতি লিটার ডিজেলে ৬ টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। কিন্তু প্রতি লিটার অকটেনে তাদের লাভ হচ্ছে ২৫ টাকা।
সংকটের মধ্যেও সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে প্রায় ৪২-৫১ শতাংশ বাড়ানোর পর জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত ৬ বছরে যে পরিমাণ লাভ করেছে বিপিসি তাতে এই দাম না বাড়ালেও চলত।
কিন্তু বিপিসি বলছে, মুনাফার টাকা অন্য প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে। তাই বিপিসির কাছে টাকা নেই। এ কারণেই চলতি মূলধনের জন্য তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে।
তবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) বলছে, লাভের টাকা অন্য প্রকল্পে ব্যয় করা সংক্রান্ত বিপিসির দাবি সঠিক নয়। সিপিডি বলছে, বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে ১১টি প্রকল্পের তথ্য পাওয়া গেছে। সেসব প্রকল্পে ব্যয় হবে ৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।
সিপিডির দাবি, এই ১১ প্রকল্পের মধ্যে আবার চলমান আছে মাত্র ৫টি প্রকল্প। বাকিগুলো বন্ধ আছে। তাহলে বিপিসির টাকা কোথায়? তারপরও লোকসান দেখিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হলো। এ বছরেও বিপিসি বিনিয়োগ করবে। জনগণের মাথায় বোঝা চাপিয়ে বিপিসি কোথায় বিনিয়োগ করবে? এমন প্রশ্ন তুলেছে সিপিডি।
লাভের হিসাবেও স্বচ্ছতা নেই বিপিসির
বিপিসির তথ্য মতে, গত ৬ বছরে লাভের পরিমাণ হচ্ছে ৪২ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। অথচ অর্থ বিভাগের করা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২২ বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিপিসি প্রকৃত লাভ করেছে ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিপিসি ও অর্থ বিভাগের হিসাবে লাভের গড়মিল হচ্ছে ৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বুধবার (১০ আগস্ট) কারওয়ান বাজারে নিজ দপ্তরে সংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিপিসি চেয়ারম্যান দাবি করেন, তিনি অর্থনৈতিক সমীক্ষা দেখেছেন। কিন্তু এমন কিছু পাননি।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত ৬ বছরে বিপিসি ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। সেখান থেকে সরকারকে দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা কোথায় বিনিয়োগ হয়েছে জানতে চাই। বিপিসির পুরাতন হিসাবের খতিয়ান চাই। জনগণের এগুলো জানা দরকার।
মূলধনের যোগান দিতেই ‘বর্ধিত দামের বোঝা’
মূলধনের যোগানের জন্য দাম বাড়ানো হয়েছে এমন কথা স্বীকারই করে নিয়েছেন বিপিসি চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ। তিনি বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে অতিরিক্ত চলতি মূলধনের দরকার হচ্ছে।
কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপিসি যদি হিসাব-নিকাশে স্বচ্ছ হতো তাহলে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হতো না। ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার নামে মূল্যবৃদ্ধি না করে অব্যবহৃত টাকা দিয়েই ভর্তুকি সমন্বয় করা যেত। ভোক্তার উপর দায় চাপানো কোনোভাবেই ঠিক হয়নি।
তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, অনেক ভালো বিকল্প থাকা সত্ত্বেও কীভাবে মাত্র কয়েক মাসের মাথায় এরকম উচ্চ হারে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেনের দাম বাড়ায়? সরকার বলছে, বিশ্ববাজারে এসব তেলের দাম বেড়েছে তাই বাধ্য হয়ে বাড়াতে হচ্ছে। কথাটা বিভিন্ন দিক থেকে ভুল।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম যখন অনেক কম ছিল তখন সরকার কয়েক বছরে লাভ করেছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। গত কিছুদিনে যে লোকসান হয়েছে তার তুলনায় এই লাভ কয়েকগুণ বেশি। সরকার জনস্বার্থ ও অর্থনীতির কথা চিন্তা করলে লাভের টাকার একাংশ দিয়েই এই লোকসান ঠেকাতে পারত।
এনএইচবি/এসজি/