বদলে যাচ্ছে কূটনীতি
বদলে যাচ্ছে কূটনীতি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দুর্বল দেশগুলোর কূটনীতি বদলে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে ‘প্রিভেন্টিভ ডিপ্লোম্যাসি’র পথে হাঁটছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগে নীতি-নৈতিকতার কথা বলে ছোট দেশগুলো তাদের একটা অবস্থান ধরে রাখত। অর্থাৎ কোনো সমস্যার মধ্যে যেতে না দুর্বল দেশগুলো। আর এখনকার কৌশল হলো সংঘাত যেন কাছে না আসে।
সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশকে ঘিরেও এমনটা দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত যেমন বাংলাদেশকে সঙ্গে চায়, তেমনি সঙ্গে চায় চীনও। বাংলাদেশ তাই প্রিভেন্টিভ ডিপ্লোম্যাসিই অনুসরণ করছে এক্ষেত্রে।
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এর বাংলাদেশ সফর শেষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রবিবার (৭ আগস্ট) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেনও তাই বললেন, বর্তমান বিশ্ব এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে একটা পক্ষ নিলে আরেকপক্ষ নাখোশ হয়। তাই তাদের আবার ম্যানেজ করতে হয়।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ থাকলে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত নাখোশ হবে কী না- এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলছেন, আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে চাই। কারো সঙ্গে থাকলে কেউ নাখোশ হলে ম্যানেজ করতে হবে।
অর্থাৎ ব্যালেন্স করার কথা বলছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশ যাতে ঝামেলামুক্ত থাকতে পারে এমন পলিসির কথাই বলছেন তিনি।
জানতে চাইলে যুক্তরাষ্টে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আগে আমরা কূটনীতিতে নরমেটিভ ফরেন পলিসি নিয়ে চলতাম। এটার মানে হলো আমরা নীতি নৈতিকতার কথা বলতাম। কোনো সমস্যার ভেতরে যেতাম না। উপর থেকে আমরা ভালো কথা বলে আমাদের অবস্থানটাকে আমরা জানান দিতাম।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, কিন্তু প্রিভেন্টিভ ডিপ্লোম্যাসিতে অনেক বেশি জোর দিতে হবে এখন। প্রচলিত কূটনীতি এখন আর নেই। আমরা তো ছোট দেশ। কাজেই আমাদের স্ট্র্যাটেজি হবে সংঘাত যেন আমাদের কাছে না আসে।
হুমায়ুন কবির বলছেন, এতদিন ইউরোপে আমরা যে ‘কোল্ড ওয়ার’ বা ঠান্ডা যুদ্ধ দেখেছি সেই কোল্ড ওয়ার কিন্তু ভিন্ন ফর্মে এশিয়ার দিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা বলি অথবা সাম্প্রতিককালে ইউক্রেনের ঘটনাবলীর কথা বলা যায়। অর্থাৎ ভূরাজনীতিটা কিন্তু এখন আমাদের গায়ের ওপর এসে পড়েছে। যেটা আগে দূরে ছিল।
এখন বাংলাদেশের জন্য যেটা চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে সেটা হলো এই ভূরাজনৈতিক ঘুর্ণাবর্তের মধ্যে বাংলাদেশ নিজেকে কীভাবে রক্ষা করবে এমন প্রশ্ন করে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, বাধ্য হয়েই ভূরাজনৈতিক কূটনীতির মধ্যে ঢুকে পড়তে হচ্ছে। আমরা চাই বা না চাই।
একটা বেসিক প্রিন্সিপাল কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে সেটি হলো কোনো একটি রাষ্ট্র আমার যা চাহিদা তার সবগুলো মিট করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে প্রাধান্য কোনটাতে বেশি বুঝতে হবে যে আমি কার সঙ্গে কাজ করব। ওই দেশের ভেতরে কীভাবে রাজনীতি বা কূটনীতিটা হয় সেটা আমাদের বুঝতে হবে। সেই জায়গাগুলোতে আমাদের দক্ষতাকে আরেকটু শান দিতে হবে।
এক্ষেত্রে শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা কূটনীতিকদের দিয়ে হবে না মন্তব্য করে হুমায়ুন কবির বলেন, আমাদের রাজনৈতিক নেতাদেরও এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। দুই স্তরেই কাজ করতে হবে। নীতিমালা তো ঠিক করে দেয় রাজনীতিকবিদরা। কূটনীতিকরা পারফর্ম করে। এখন আমরা একটা জটিল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। রাজনৈতিক নেতাদেরও কিন্তু এটি হ্যান্ডেল করতে হবে।
হুমায়ুন কবির আরও বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয় অনেক দেশই এই সমস্যায় পড়ছে। তাদের সঙ্গেও আমাদের সংযোগ বাড়াতে হবে। যাতে কোনো একটা ইস্যুতে তাদের অবস্থান বুঝে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়।
আরেকজন সাবেক রাষ্ট্রদূত এ কে এম আতিকুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাদের স্বাধীনতা, ভৌগলিক অখণ্ডতা, আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোনোভাবে আপস করা যাবে না। সেই সঙ্গে এমনকিছু করব না যাতে আমেরিকার মানুষের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হয়। কারণ এখনকার ডিপ্লোম্যাসির মূল কথা হলো পিপল টু পিপল কন্টাক্ট।
চীনের সঙ্গেও আমাদের অনেক ব্যবসা বাণিজ্য আছে। এই বিষয়টিও লক্ষ্য রাখতে হবে। আঞ্চলিকতার একটা বিষয় আছে। চীনের সঙ্গে আমাদের যে বিনিয়োগের সম্পর্ক সেটা মাথায় রাখতে হবে। এগুলো মাথায় রেখে আমেরিকাকে হ্যান্ডল করতে হবে।
আতিকুর রহমান বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের পাশাপাশি রাশিয়া আমাদের সহযোগিতা করেছে। সেই বিষয়টিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
এনএইচবি/এসএন