কুষ্টিয়ার সবজি ব্যবসায়ীদের লোকসান ঘোচাবে পদ্মা সেতু
কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী, মিরপুর, ভেড়ামারা, দৌলতপুর, খোকসা ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ করা হয়। এসব সবজি ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
কিন্তু সবজি ব্যবসায়ীদের প্রায়ই লোকসান গুনতে হয়। সেই লোকসানের হাত থেকে বাঁচার ও দ্রুত সবিজ বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন কুষ্টিয়া অঞ্চলের ব্যবাসয়ীরা।
তাদেরকে সেই স্বপ্ন দেখাচ্ছে বাংলাদেশের সমৃদ্ধির প্রতীক পদ্মা সেতু। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্য জেলাগুলোর মতো কুষ্টিয়ার মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি জীবনমান উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে স্বপ্নের সেতু।
তাই তো পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে কুষ্টিয়া শহরেও। বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে এই জেলাকে। কুষ্টিয়া শহরের সড়কবিভাজক জুড়ে শোভা পাচ্ছে সেতু কেন্দ্রিক নানা রঙের ব্যানার ফেস্টুন ।
পদ্মা সেতু নির্মানের কারনে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার সাধারণ মানুষ খুব একটা উপকৃত না হলেও ব্যবসায়ীরা পদ্মা সেতু ব্যবহার করে পণ্য পরিবহনে বড় ধরনের সুবিধা পাবেন- এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সবজি ছাড়াও কুষ্টিয়া জেলার দুই হাজার হেক্টরের অধিক জমিতে পান চাষ করা হয় চার হাজার হেক্টর জমিতে। কুষ্টিয়ার এসব সবজি, কলা ও পানসহ বিভিন্ন কাঁচা পণ্য রাজধানী ঢাকার একটা বড় অংশের চাহিদাও পূরণ করে। প্রতিদিন কুষ্টিয়ার বিভিন্ন হাট থেকে শতাধিক ট্রাক বিভিন্ন সবজি, কলা ও পান ঢাকা চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার বাজারে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু পচনশীল এসব পণ্য ঢাকা, চট্টগ্রামে পাঠানো হয় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরি ঘাট দিয়ে। কিন্তু ফেরি ঘাটে অধিকাংশ দিন যানজট বাধায় ঠিক সময়ে এসব পণ্য গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। আবার যানজট দীর্ঘ হলে এসব কাঁচা পণ্যের অধিকাংশ নষ্ট হয়ে যায়।
পদ্মা সেতু এখন এসব এ অঞ্চলের কাঁচা পণ্যের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছে।
কুষ্টিয়ার পাইকারি সবজি বিক্রেতা সবুজ হোসেন বলেন, আমি জেলার বিভিন্ন এলাকার মাঠ থেকে সব ধরনের সবজি কিনে ঢাকায় বিভিন্ন পাইকারি বাজারে বিক্রি করি। ঢাকায় পণ্য দ্রুত পৌঁছানোর বড় বাধা ফেরি ঘাটের যানজট। দীর্ঘ সময় যানজটে থেকে বহুদিন সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। এ জন্য আমাকে বেশ কয়েকবার লোকশান গুনতে হয়েছে। এখন পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ায় ফেরিঘাটের জটে পড়ে সবজি পচার ভয় থাকবে না। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে সবজি পৌঁছে দিতে পারব। আগের চেয়ে বেশি পরিমানে সবজি বিক্রিও হবে।
কুষ্টিয়া জেলা উদ্যোক্তা ফোরামের সভাপতি ও খাজানগরের মিল মালিক ইমরান হোসেন বলেন, একটা দেশের উন্নয়নের পেছনে যোগাযোগ ব্যবস্থা বড় একটা ভূমিকা রাখে। পদ্মা সেতু হচ্ছে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের সেতু। খাজানগরের চাল ব্যবসায়ীরা এই সেতুর ফলে তাদের উৎপাদিত চাল খুব সহজে এবং অল্প সময়ে ঢাকাসহ পূর্বঞ্চালের জেলাগুলোতে পৌঁছে দিতে পারবেন। সমানভাবে মালামাল সহজে নিয়েও আসা যাবে। এতে করে কুষ্টিয়া জেলায় চালকলসহ নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে এবং ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে।
শিল্প নগরী হিসেবেও পরিচয় আছে কুষ্টিয়ার। এ জেলায় ১৫টি বৃহৎ, ৩৮টি মাঝারি, ৫ হাজার ২১২ টি ক্ষুদ্র ও ২১ হাজার ৮৩৭ টি কুটির শিল্প এখানে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র এবং বহু কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাট ও মাওয়া ফেরিঘাটে দীর্ঘ যানজটের কারণে পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে এক থেকে দুই দিন পদ্মার পারেই অপেক্ষায় থাকতে হয়। পদ্মা সেতু চালু হলে এই ভোগান্তি আর থাকবে না। একদিনেই ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চালের জেলাগুলোতে কুষ্টিয়ায় উৎপাদিত পণ্য সহজে ও অল্প সময়ে কোনো রকম ভোগান্তি ছাড়া পৌঁছে দেওয়া যাবে। একইভাবে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সহজে অল্প সময়ের মধ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আনা যাবে। এতে করে শিল্প কারখানার উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও প্রসার ঘটবে।
কুষ্টিয়া কুমারখালী তাঁত শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ও বিখ্যাত। এখানকার উৎপাদিত লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালে, বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় পোড়াদহ হাট ও কুমারখালী কাপড়ের হাট থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা। এই দুই হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০৪ কোটি টাকার কাপড় বিক্রি হয়। এতদিন এসব ব্যবসায়ীদের দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাট ব্যবহার করে যাতায়াত করতে হতো। পদ্মা সেতুর ফলে এখন আর ফেরিঘাটের ভোগান্তি থাকবে না।
কুমারখালী মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাজাহান আলী মোল্লা বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে আমাদের ব্যবসায়ীদের অনেক উপকার হবে। ঘাটে যে দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকতে হতো সেটা আর হবে না। তবে পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল করলে আমাদের জন্য বেশি উপকার হবে। অল্প খরচে ব্যবসায়ীরা মালামাল পরিবহন করতে পারবেন।
কুষ্টিয়া চেম্বার অব কর্মাস ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক ও জেলা দুনীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি এস এম কাদেরী শাকিল বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে কুষ্টিয়া অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বেশ উপকৃত হবেন। কুষ্টিয়া একটা শিল্প নগরী এখানে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। কিন্তু দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাট ও মাওয়া ঘাটের ফেরি পারাপারের ভোগান্তি দীর্ঘ যানজট পণ্য পরিবহনকারী ট্রাককে অনেক সময় এক দিন দুই দিন ঘাটে বসে থাকতে হতো।
পদ্মা সেতুর ফলে এই ভোগান্তি আর থাকবে না। তিনি বলেন, এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার আরও প্রসার ঘটাতে পারবেন। বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার মানুষের দীর্ঘ দিনের দাবি দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর।
পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন হলে কুষ্টিয়ায় পর্যটকের সংখ্যা আগের চেয়ে কয়েকগুন বাড়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি, মরমী সাধক বাউল সম্রাট লালন শাহ এর মাজার ও জাদুঘর, ঝাউদিয়া শাহী মসজিদ, সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের এম এন প্রেস ও স্মৃতি জাদুঘর, বিষাদ সিন্ধু রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা ও স্মৃতি জাদুঘর, বিচারপতি রাধা বিনোদ পালের স্মৃতি ধন্য জন্মভূমি, বিপ্লবী জমিদার প্যারীসুন্দরীর ভিটা, শিলাইদহ খোরশেদপুরের ৪০০ বছর পুরোনো গোপিনাথ জিওর মন্দিরসহ বহু ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোতে পর্যটকের উপস্থিতি বাড়বে। এর ফলে পর্যটন কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্য বাড়বে। সৃষ্টি হবে নানামুখী কর্সংস্থানের।
শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ীর কাস্টোডিয়ান মো. মখলেছুর রহমান ভূঁইয়া জানান, পদ্মা সেতু দেশের একটি বিরাট অর্জন। এই সেতুর ফলে পদ্মার এপারের জেলার মানুষ প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষভাবে অনেক সুবিধা পাবেন। অর্থনৈতিকভাবে সম্মৃদ্ধ হবে এ অঞ্চল। তিনি বলেন, কুষ্টিয়া জেলা সংস্কৃতির রাজধানী এ জেলায় পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষের আগমন ঘটে। পদ্মা সেতু নির্মাণ হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে আশা করা যায় এর সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। এ এলাকার মানুষের আয়ের উৎস বৃদ্ধি পাবে। সরকারের রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে।
পরিবহন ব্যবসায়ও বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। কুষ্টিয়া থেকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাট হয়ে ঢাকায় পৌঁছতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে এই অঞ্চলের মানুষকেল। সঙ্গে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা অতিরিক্ত ভোগান্তি। পদ্মা সেতু চালু হলে কুষ্টিয়া থেকে সরাসরি বাস গুলিস্তান বা সায়েদাবাদে চলাচল করলে কুষ্টিয়া জেলার মানুষের ভোগান্তি অনেকাংশে কমে যাবে এবং সময়ও বাঁচবে।
কুষ্টিয়া জেলা বাস মিনিবাস মালিক গ্রুপের কার্যকরী সভাপতি মো. নূরুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে কুষ্টিয়া জেলার যাত্রীরা যারা গুলিস্তান সায়েদাবাদ হয়ে পূর্বাঞ্চলের জেলায় যাতায়াত করেন তারা বেশ সুবিধা পাবেন। আগামীতে আমরাও কুষ্টিয়া থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে বাস চালাব। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু দিয়ে এসবি সুপার ডিলাক্স ও স্কাই লাইন পরিবহন ঢাকায় বাস চালানোর চিন্তা ভাবনা করছে।
কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আজগর আলী তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে বহু ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সকল ষড়যন্ত্র পেছনে ফেলে নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছেন। পদ্মা সেতুর ফলে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের সাধারণ মানুষ যেমনটা উপকৃত হবেন, তার চেয়ে বেশি উপকৃত হবেন ব্যবসায়ীরা। ফেরি ঘাটের অপেক্ষায় না থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে ১০ মিনিটে নদী পার হতে পারবে পণ্যবাহী যানবাহন। এতে ব্যবসার আরও প্রসার ঘটবে।
তিনি বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ও প্রত্যাশা দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া পয়েন্টে আরেকটি পদ্মা সেতু নির্মাণের। আমরা আশা রাখি জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের জন্য দ্রুতই দ্বিতীয় পদ্মা সেতু গড়বেন।
এনএইচবি/এমএমএ/