জুরাইনে পুলিশের উপর হামলার নেপথ্যে…
'পুলিশের ত্যাড়ামির কারণে তুচ্ছ বিষয় থেকেই পুলিশের উপর হামলা এবং পুলিশ বক্স ভাঙচুরের মত বড় ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর জুরাইনে।' মঙ্গলবারের (৭ জুন) ওই ঘটনার পর বুধবার (৮ জুন) ওই এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য জানা গেছে।
অবশ্য ট্রাফিক পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. সাইদুল ইসলাম বলেছেন, ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ওই নারীর গায়ে কাউকে হাত দিতে দেখা যায়নি।
মঙ্গলবার জুরাইনে মোটরসাইকেল আরোহী এক দম্পতিকে আটকানোর পর কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ট্রাফিক পুলিশের উপর চড়াও হয়েছেন স্থানীয় লোকজন। এতে সার্জেন্ট আলী হোসেনসহ ট্রাফিক কনস্টেবল সিরাজুল ইসলাম ও শ্যামপুর থানার উপপরিদর্শক উৎপল চন্দ্র আহত হন।
বুধবার ওই এলাকায় গিয়ে সাধারণ মানুষ কথা বললে তারা জানান, পুলিশের ত্যাড়ামির কারণে অপ্রিতিকর ঘটনাটি ঘটেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, যারা এ ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন তারা বেশিরভাগ পথচলতি মানুষ।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, প্রথমে মো. রনিকে পাঠাও চালক ভেবে গাড়ি চেক করতে চান সার্জেন্ট আলী হোসেন। রনির সঙ্গে তার স্ত্রী ইয়াছিন জাহান (নিশিতা) ছিলেন। এসময় রনি সার্জেন্টকে বলেন, সামান্য একটু পথ যাচ্ছি ভাই ছেড়ে দেন, পেছনে অসুস্থ রোগী। অন্যথায় অনেক ঘুরতে হবে। অতটুকু রাস্তা ছেড়ে দিলে আপনার আহামরি ক্ষতি হবে না। এমন কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে সার্জেন্ট মোটরসাইকেলের চাবি নিয়ে নেন। এরপর দুজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয় এবং হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তখন রনির স্ত্রী ঠেকাতে গেলে পুলিশ তাকেও মারধর করেন বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে জড়ো হওয়া জনতা এর প্রতিবাদ করেন।
স্থানীয়রা জানান, একপর্যায়ে সার্জেন্ট রনি ও তার স্ত্রীকে পুলিশ বক্সের ভেতরে নিয়ে যান এবং রনির গায়ে হাত তোলেন। এসময় রনি ভিডিও করেন। আশেপাশের লোকজন জড়ো হয়ে পুলিশ বক্সের দিকে যান। এরই একপর্যায়ে জনতা, হকার ও ব্যবসায়ীরা পুলিশ বক্স ঘেরাও করে রনিকে ছেড়ে দিতে বলেন। তারা ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। রনিকে না ছাড়ায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ বক্সে হামলা করেন এতে গ্লাস ভেঙে আলী হোসেনসহ তিন জন পুলিশ সদস্য আহত হন।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক পুলিশ বক্স বিপরীতে থাকা ইসলামী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা (নারী) বলেন, আমরা দোতলা থেকে দেখছি পুলিশ প্রথমে ওই ব্যক্তি ও তার স্ত্রীকে আজেবাজে কথা বলা শুরু করে এবং টেনে-হিঁচড়ে ট্রাফিক বক্সের মধ্যে নিয়ে যায়। ঘটনাটি সাধারণ মানুষ দেখে সবাই একত্রিত হয়। তবে এখানে স্থানীয় দোকানদার ও চলাচলরত সাধারণ মানুষ বিক্ষুদ্ধ হয়ে পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ বক্সে হামলা করে।
পুলিশ বক্সের বিপরীতের বিক্রমপুর প্লাজার দুজন নিরাপত্তাকর্মী বলেন, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে। পুলিশ ইচ্ছা করলে তাদের ছেড়ে দিতে পারত। তারা বারবার বলছিল আমাদের গাড়ির কাগজপত্র সব ঠিক আছে। কিন্তু নাছোড়বান্দা পুলিশ তাদের না ছাড়ায় এই ঘটনাটি ঘটে।
জুরাইন এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী পলাশ আহমেদ বলেন, পুলিশের উপর হামলা হয়েছে এটা দুঃখজনক ঘটনা। তবে পুলিশ অন্যায় করেছে। কত মটরসাইকেল রং রোড দিয়ে চলাচল করে পুলিশ তো তাদের কিছু বলে না । তাছাড়া এখানে কাটা রাস্তা নেই, এই জন্য মূলত সমস্যাটা তৈরি হয় সবাই রং রোড দিয়ে চলাচল করে।
পুলিশবক্সের বিপরীতের ডাচ বাংলা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, সকালে দেখলাম এক ব্যক্তি ও এক মহিলা মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। তাদের মাথায় হেলমেটও ছিল। এ সময় ট্রাফিকের একজন সার্জেন্ট মোটরসাইকেলটি থামান। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে ট্রাফিক সার্জেন্ট নারীর গায়ে হাত তোলেন এবং তাদের পুলিশ বক্সের দিকে নিয়ে যান। তখনই এলাকার লোকজন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তারা পুলিশ বক্স লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন।
তিনি বলেন, আজ সকালের খবর শুনলাম এই ঘটনায় পুলিশ মামলা করেছে। এটা শুনে আরও দুঃখ লাগল।
স্থানীয় একটি দোকানের মালিক মো. হৃদয় বলেন, এ ঘটনার সময় আমি ছিলাম না। আমার কর্মচারী ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, এ ঘটনাটি ঘটেছে পুলিশের কারণে। পুলিশ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে।
মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজের মো. জীবন বলেন, এ ঘটনায় যারা প্রতিবাদ করেছিলেন তারা সবাই ছিলেন এলাকার বহিরাগত। বেশির ভাগ মানুষ পথচলতি। আজ সকালে শুনলাম এলাকাবাসীর নামে মামলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, পুলিশের উপর হামলার ঘটনায় ট্রাফিক পুলিশ বাদী হয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে। আমরা জানতে পেরেছি সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এক ব্যক্তি একজন নারীকে নিয়ে উল্টো পথে বাইক চালিয়ে আসছিলেন। ওই নারীর মাথায় হেলমেট ছিল না। এ সময় এক ট্রাফিক কনস্টেবল বাইকসহ চালককে রাস্তার পাশে দাঁড়াতে বলেন। ট্রাফিক সার্জেন্ট তার কাছ থেকে কাগজপত্র দেখতে চান। উল্টো ওই ব্যক্তি পুলিশের কাগজ চেক করতে চেয়েছিল।
তিনি বলেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ট্রাফিক পুলিশকে ‘বডিওর্ন’ ক্যামেরা দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনার পরে ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ দেখা হচ্ছে এবং এ বিষয়ে তদন্ত চলছে, বিস্তারিত পরে বলতে পারব।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ট্রাফিক পুলিশ প্রথমে ওই নারীর গায়ে হাত তোলেন। এর জবাবে ট্রাফিক পুলিশের ডিসি বলেন, ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ওই নারীর গায়ে কাউকে হাত দিতে দেখা যায়নি।
জুরাইন এলাকার একাধিক মানুষ ও ভিডিও ফুটেজ দেখে জানা গেছে, পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষের একাধিক ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ হয় যা ওই ব্যক্তি নিজেই করেন। তাছাড়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজন ও বিভিন্ন ভিডিও করেছে ভিডিওতে বাইকে থাকা ব্যক্তিকে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বলতে শোনা গেছে, জুরাইন ট্রাফিক পুলিশ বক্স এর সদস্যরা অনেক দিন ধরে ফুতপাতের ব্যবসায়ী ও চলাচলরত মানুষদের গাড়ি চেকের নামে অত্যাচার করে আসছে এ সুযোগে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন যখন পুলিশের উপর চড়াও হচ্ছিলেন, সে সময় মো. রনি ও তার স্ত্রীকে ঘটনাস্থলের পাশের পুলিশ বক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ফেসবুকে লাইভে যান রনি। লাইভে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘বাংলাদেশের জনগণ দেখেন, যারা প্রত্যেকদিন জুরাইনে চাঁদাবাজি করে, চাঁদাবাজি করার সময় আমার সঙ্গে কথা হয়। আমার সঙ্গে তারা বাজে আচরণ করেছে এবং একপর্যায়ে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে মারধর করেছে। কোন আইনে আছে মারধর করা যাবে? কেন আপনি মারলেন?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্যামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মফিজুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, এ ঘটনায় মো. রনিসহ তিনজনকে আটক করা হয়েছে। ৪০০ জনের নামে মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে ভালোভাবে বলা যাবে।
সার্জেন্ট ফারুক, আশিক, ইমরুল ও নিতাই বলেন, সামান্য ঘটনা এত বড় হবে কোনোভাবেই এটা কাম্য ছিল না। তাছাড়া যার সঙ্গে ঘটনা ঘটেছে সে খুব ভদ্র মানুষ।
জুরাইন পুলিশ বক্সের ইনচার্জ (টিআই) বিপ্লব ভৌমিক বলেন, আমাদের জয়েন কমিশনার স্যার বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছেন। বিস্তারিত তার সঙ্গে কথা বলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এডিশনাল পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক (প্রধান) মো. মনিবুর রহমান বলেন, ঘটনাস্থল আমি তদন্ত করেছি। ডিউটিরত পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। এ ঘটনায় ট্রাফিক পুলিশ বাদী হয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে।
এ বিষয়ে কোনো তদন্ত কমিটি হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনো পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে আমাদের কাজ চলছে। তবে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সবকিছু বিবেচনা করেই আমরা কাজ করছি।
কেএম/আরএ/