সরকার পতনে বৃহত্তর ঐক্যের চেষ্টা বিএনপির
বিএনপির লোগো
নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে মরিয়া বিএনপি। চেষ্টা করছে বৃহত্তর ঐক্যের। সে লক্ষ্যে সমমনা এবং সরকার বিরোধী ছোট-বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলে একসঙ্গে সরকার পতনের আন্দোলন করতে চায় বিএনপি। ইতোমধ্যে বিএনপি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করছে। সাংগঠনিকভাবে কোণঠাসা বিএনপির তৃণমূল পর্যায় থেকে জোরালো চাপ থাকলেও দাবি আদায়ে ‘একলা চলো’ নীতিতে যেতে পারছে না দলটি।
এই অবস্থায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবার সরকার পতন আন্দোলনে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই সংলাপে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
অথচ বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের সংলাপকে ‘অর্থহীন’ আখ্যা দিয়ে বিএনপির মহাসচিব তখন বলেছিলেন, সংলাপে গিয়ে কোনো লাভ হবে না।
গত ২৪ মে বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করেছে দলটি। যা চলতি মাসেই শেষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। সেই বিবেচনায় সংলাপ শেষে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পথে রুপ নেবে বলে আশাবাদী হয়ে উঠছে বিএনপির নেতৃত্ব। সংলাপ ইস্যুতে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বললে এমনটাই জানা গেছে।
সংলাপের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে আরও সুসংগঠিত ও বৃহত্তর ঐক্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিএনপির চলমান সংলাপ। এই সংলাপ সবেমাত্র শুরু, স্বাভাবিক কারণেই এর কার্যকারিতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো কিছুটা সময় লাগবে। তবে আমরা আশাবাদী সংলাপ সফল হবে।
২০১৮ সালে জাতীয় ঐক্য গঠনের সঙ্গে এখন আবার নতুন করে বৃহত্তর ঐক্য গঠন চেষ্টায় কোনো পার্থক্য আছে কী—এমন প্রশ্নের তিনি বলেন, তখন ২০ দলীয় জোট ছিল। পাশাপাশি গঠিত হয়েছিল একটি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তাই এখানে কিছুটা ফারাক ছিল। যদিও সেই বিষয়টিকে আমরা গুরুত্ব দেই না। তবে এবার জোট গঠনের চেয়ে যুগপৎ আন্দোলনে যেতে সরকার বিরোধী সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, বিএনপির চলমান বৃহত্তর ঐক্য গঠনের চেষ্টায় সংলাপে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। যারাই এই অনির্বাচিত সরকারকে সমর্থন করে না, বিরোধীতা করে, গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক সেই সব দলমত নির্বিশেষ ব্যক্তিদের মধ্যে একটা জাতীয় ঐক্যমত সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি। আমরা আশাবাদী যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বৃহত্তর ঐক্য গঠনে একটি কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাতে পারব। বিএনপির চলমান সংলাপ নিয়ে জনগণের মধ্যেও বেশ সাড়া পাচ্ছি।
বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র মতে, রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন নেই। আলাদা অস্তিত্বে তারা নির্বাচন করতে পারবে না। বিএনপির নীতি নির্ধারকদের ভাবনা- এখনও যেহেতু জামায়াতের ইসলামীর বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে, সাংগঠনিক শক্তিও আছে। এই কারণে দলের ভেতর-বাহির এবং আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করেও জামায়াতে ইসলামীকে যেভাবে জোটে ধরে রাখা হয়েছে, একইভাবে ভবিষ্যৎ আন্দোলন সংগ্রামেও পাশে থাকবে জামায়াতে ইসলামী। তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপ করা সম্ভব না হলেও অভ্যন্তরীণভাবে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যেসব বিরোধী দল কথা বলছে, বিশেষ করে আগামী নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে না করার বিষয়ে সংলাপে একসুরে কথা বলছে, এই বিষয়টিকে বিএনপির পক্ষ থেকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ বিশেষ কোনো রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের চেয়ে কৌশলগত কারণে ভিন্ন-ভিন্ন পদ্ধতিতে সংলাপ প্রক্রিয়া নিয়ে এগোতে চাইছে বিএনপি হাইকমান্ড। এ কারণেই আগে-ভাগে দাবিনামা উত্থাপন না করে মাঠপর্যায়ে মতামত তৈরির প্রক্রিয়ায় সংলাপকে সামনে আনা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমরা জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে চাই। তাই এমন কিছু করা চলবে না যেন, আমাদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়। আমাদের একটাই শর্ত, এই সরকারের পতন এবং জাতীয় সংসদ বাতিল করতে হবে। সরকারের পতনের পর যদি কোনো দরকষাকষি থাকে সেটা দেখা যাবে। কিন্তু সরকার পতনের আন্দোলনে এক থাকতে হবে।
তিনি বলেন, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে দেশের গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলো অঙ্গীকার করেছে। দেশ ও জনগণের কথা মাথায় রেখে আস্থা, বিশ্বাস এবং মনোবল ঠিক রাখা গেলে সরকারের বিরুদ্ধে বিনাযুদ্ধে আমরা জয়লাভ করতে পারব।
২০ দলীয় জোট শরিক বাংলাদেশ লেবার পার্টি-বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি এবং জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দল নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে সংলাপ করেছে বিএনপি। সেই সংলাপে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ঐক্যমত তৈরি হয়েছে বলে সংলাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর পক্ষ থেকে পৃথক পৃথকভাবে বলা হচ্ছে।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম জানান, বিএনপি মতবিনিময় শুরু করেছে। তবে যারা বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিলেন না, তাদের সঙ্গে মতবিনিময় আর জোটে ছিলেন তাদের সঙ্গে মত বিনিময়ের ক্ষেত্রে কাঠামোগত কিছুটা পার্থক্য হবেই। আমরা দশটি বছর একসঙ্গে চলছি। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি বিএনপির অনুকূলে আন্দোলনে ও বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় থাকতে।
তিনি বলেন, কল্যাণ পার্টির পক্ষ থেকে বিএনপিকে প্রস্তাব করা হয়েছে, ভবিষ্যতে যেকোনো কারণে যদি ২০ দলীয় জোটকে সক্রিয় করা সম্ভব না হয়, তাহলেও আমরা যুগপৎ আন্দোলন করতে প্রস্তুত। এটাও বলেছি, জোটকে সক্রিয় করার কাজে অথবা জোটের মধ্যে আরও দলকে একত্রিত করতে আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
উল্লেখ্য, দাবি আদায়ে ২০১২ সালেও বিএনপি নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট গঠন হয়েছিল। এর ধারাবহিকতায় ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া জোটবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সেই জোট ছেড়ে চলে যায়। পরবর্তীতে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত থেকে নির্বাচনের অংশ নেয় বিএনপি। আর যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বারস্থ হয়ে একাদশ নির্বাচনে অংশ নেয়। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ যখনই দাবি আদায়ে জোট গঠন করে রাজপথে আন্দোলনে যায়, তখনই সফলতা ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু রাজপথের আন্দোলনের জন্য রাজনৈতিক জোট করে কিংবা নির্বাচনী জোট তৈরি করেও আওয়ামী লীগের কাছে রাজনৈতিক কৌশলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটকে বার বার হোঁচট খেতে হয়েছে।
এমএইচ/এনএইচবি/আরএ/