প্রশ্নবিদ্ধ সাংবাদিকতা: উত্তরণের পথ (৪)
স্বার্থের দ্বন্দ্বে পরাজিত সাংগঠনিক শক্তি
সাংবাদিকতা। পেশাটি এখনও মহান। সম্মানের। এর বিপরীতে প্রতি কদমেই রয়েছে প্রলোভনের টোপ। পদবির উচ্চতা অনুযায়ী প্লট, টেলিভিশন বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স, বিদেশ ভ্রমণের আগে ডলারের খাম। আর একটু নিচে তাকালে চোখে পড়বে জন্মদিনে স্মার্ট টিভি উপহার; এমনকি থানা থেকে একশ টাকার ফ্লেক্সিলোডও। হয়তো সংখ্যায় তারা কমই; কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাব বড় বেশি শক্তিশালী। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছেন পাশের সহকর্মীকে। পেশাটি ক্রমেই হয়ে উঠছে আরও চ্যালেঞ্জিং। আর রাজনীতি চলছে ‘ইউ আর আইদার উইথ মি অর এগেইনস্ট মি’ নীতিতে। দলীয় রাজনীতির বিভাজক দেওয়ালের পুরুত্ব বাড়ছে দিনকে দিন। স্বার্থের দ্বন্দ্বে পরাজিত সাংগঠনিক শক্তি। পরিণত হয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তাবুতে। তবু সাংবাদিকতা আছে, থাকবে; কিন্তু উত্তরণের পথই বা কী? এসব সমস্যার সমাধান নিয়ে ঢাকাপ্রকাশের পক্ষ থেকে মুখোমুখি হওয়া গণমাধ্যম গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিকদের। তাদের মতামতের ভিত্তিতে ‘প্রশ্নবিদ্ধ সাংবাদিকতা: উত্তরণের পথ’ শীর্ষক ঢাকাপ্রকাশের ধারাবহিক এ আয়োজনে আজ থাকছে চতুর্থ পর্ব।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে নানা দাবি আদায়ের জন্য সাংবাদিকদের প্রয়োজন একটি শক্তিশালী সংগঠন; কিন্তু রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘শক্তির জায়গা তখনই আসবে, যখন সাংবাদিকরা নিজেদের বিএনপিপন্থী, আওয়ামী লীগপন্থী, বামপন্থী–থেকে বেরিয়ে এসে, সৎ সাংবাদিকতাপন্থী বলে মনে করবে। একটি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সততার চর্চা করে দেখাতে এবং প্রমাণসহ যখন প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন, তখন পাঠকরাও তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসবে। বৃহত্তর পাঠক সংযুক্তি না থাকলে একটা লড়াই করা কঠিন হয়ে যায়। আর পাঠক তখনই সমর্থন দেবে, যখন তারা দেখবে তার স্বার্থে সাংবাদিক লড়াই করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাজনীতিতেও অনেক সৎ মানুষ আছেন, যারা দেশের উন্নতি চান, সৎ সাংবাদিকতা চান, তাদেরও সক্রিয় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরও সততার প্রমাণ দিতে হবে। তাহলে সেসব লোক সাংবাদিকদের পক্ষে কথা বলবেন। সাংবাদিকদের দোনোমনা থেকে বের হতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘রাজনৈতিক ভিন্নতা থাকতে পারে তবে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতার বাইরে কিছু চিন্তা করা যাবে না। সাংবাদিক নেতারা যদি এ বিষয়ে একটি জায়গায় অবস্থান নিতে পারে তাহলে দেশের জন্য মঙ্গল হবে। তবে একটি দেশের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা, সাতন্ত্র্যর ক্ষেত্রে কোনো বিভেদ মেনে নেওয়া যায় না। তবে সেটি ঘটেছে অনেক পেশায়।’
আরো পড়ুন
ক্ষমতাবান ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধক
সাংবাদিকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়ে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, ‘একজন মানুষের দর্শন বা রাজনৈতিক বিশ্বাস না থাকলে তিনি সাংবাদিকতা করতেও পারবেন না; কিন্তু সংবাদ পরিবেশেনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রয়োগ হচ্ছে কি না, সেটি গুরুত্বপূর্ণ।’
এ প্রসঙ্গে একই রকম মত দিয়েছেন ডিবিসি নিউজের সম্পাদক ও গণমাধ্যম গবেষক জায়েদুল আহসান পিন্টু। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের রাজনৈতিক মোটিভেশন থাকাও উচিত। পাকিস্তান আমলে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীনের জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলাম। পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে; কিন্তু রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে মতামত লিখতে পারেন।’
সাংবাদিক সংগঠন ও ইউনিয়নগুলোর নির্বাচনে দলীয় প্রভাবের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যদিও ঘোষণা দেয় না আমরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি করি, কিন্তু এটা স্পষ্ট দুটা ভিন্ন আদর্শের সাংবাদিকতার সংগঠন। ৯৩ সালে আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক ইউনিয়ন, বিএনপিপন্থী সাংবাদিক ইউনিয়ন হয়ে গেল। যেটা সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।‘
সাংবাদিকদের রাজনৈতিক বিভাজনের কারণেই সরকারের লোকজন যা চায়, তা অনায়াসে করে নিতে পারে বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ এ সাংবাদিক। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের ভেতরে যখন রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে মালিক শ্রেণি এক ধরনের শোষণ করে, আবার সরকারের পক্ষ থেকেও এক ধরনের শোষণ বা চাপ সৃষ্টি করা হয়। আমরা যদি এক হয়ে প্রতিবাদটা করতে পারতাম সরকার সেখান থেকে সরে আসত।’
রাজনৈতিক বিভাজন থেকে বেরিয়ে এসে একটি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো সম্ভব কি না–এমন প্রশ্নের জবাবে এ গণমাধ্যম গবেষক বলেন, ‘বের হয়ে আসা কঠিন, তবে সম্ভব। রাজনৈতিক বিভাজন এত বেশি যে, সেখান থেকে বের হয়ে আসা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। রাজনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত বলেই এত বিভাজন। তবে এটা মনে করা যাবে না যে, সব সাংবাদিক রাজনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত। এখান থেকে বের হতে হলে সিনিয়র সাংবাদিকদের একটি কমন প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে আর জুনিয়রদের কাছ থেকে একটা চাপও আসতে হবে।’
আরো পড়ুন
স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
যে কোনো পেশাজীবীদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য পেশাসংশ্লিষ্ট সংগঠন বা ইউনিয়ন থাকে। সাংবাদিকদেরও রয়েছে তেমন ইউনিয়ন বা ক্লাব। প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ফেডালের সাংবাদিক ইউনিয়ন, সাব এডিটরস কাউন্সিল। এ ছাড়া রয়েছে নানা বিটভিত্তিক ও অঞ্চলভিত্তিক সাংবাদিক সংগঠন। সংগঠনের অভাব নেই, তবে অভাব আছে শক্তির। স্বার্থের দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়েছে সাংগঠনিক শক্তি।
এত সাংবাদিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে সাংবাদিক নেতা সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, ‘বিশেষায়িত বিট যেমন–বিজনেস, স্পোর্টসের ক্ষেত্রে আলাদা সংগঠন প্রয়োজন হতে পারে। সংগঠন করা দরকার স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রবাহে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে। সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করতে নয়। তবে কল্যাণমূলক কনসার্ট, অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, মর্যাদার লড়াইয়ের জন্য সংগঠন দরকার।’
তবে এ ব্যাপারে ভিন্ন মত দিলেন ডিবিসি নিউজের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের এত সংগঠনের দরকার হতো না যদি মাদার অরগানাইজেশন (মূল প্রতিষ্ঠান) ঠিক থাকত। একটি প্রেসক্লাব ও একটি সাংবাদিক ইউনিয়ন যথেষ্ট। প্রেসক্লাবে সাংবাদিকরা আড্ডা দেবে। এর মধ্যে নানা জ্ঞানের আলোচনা হবে, খেলাধুলা হবে, বিনোদনও হবে। আর পেশাগত উন্নয়ন, রুটি-রুজি, অনিয়ম প্রতিরোধে, ন্যায্যতা আদায়ের জন্য সাংবাদিক ইউনিয়ন থাকবে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান যদি ঠিকমতো কাজ করে, তাহলে তৃতীয় প্রতিষ্ঠানের দরকার হতো না।’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এক সময় পেশাদার সাংবাদিকরা প্রেসক্লাবে ঢুকতে পারতেন না। এখানেও আওয়ামী লীগ-বিএনপির লোক দেখে বাছাই করা হতো, কে সদস্য হবে, কে হবে না। এসব কারণে সেখান থেকে বের হয়ে রিপোর্টাস ইউনিটি করতে হয়েছে।’
রাজনৈতিক বিভক্তি, সাংগঠনিক দুর্বলতার বাইরেও সাংবাদিকতা আক্রান্ত আরেকটি রোগে। ঘুষ বা দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া। দুর্নীতির খবর ফাঁস করার হুমকি দেওয়া, টাকার বিনিময়ে মিথ্যা খবর দেওয়া বা খবর বন্ধ করা। এসব ক্ষেত্রে ঘুষের পরিমাণও নির্ধারিত হয় পদের ওজন বুঝে।
আরো পড়ুন
গোপন সমঝোতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সাংবাদিকতা
চাকরির নিশ্চয়তা, আর্থিক সচ্ছলতা না থাকার কারণে সাংবাদিকদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি না–এমন প্রশ্নের জবাবে সাজ্জাদ আলম খান বলেন, ‘অল্প বেতন পেলেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে, সাংবাদিকতায় না আসা ভালো। তবে আমরা ন্যায্য বেতন চাই। ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী বেতন চাচ্ছি। একটি ভালো প্রতিষ্ঠানই পারে সাংবাদিকতার ভালো ক্ষেত্র তৈরি করতে। এখানে ব্ল্যাকমেইলিং বা কাউকে করায়ত্ব করার সুযোগ থাকেব না। এজন্য ভালো বেতন, প্রতিষ্ঠান ও মর্যাদা থাকা দরকার। এ ছাড়া আইনিভাবেও সুরক্ষা দিতে হবে।’
সাংবাদিকদের বেতন অনেক কম দেওয়া হয় স্বীকার করে ডিবিসি নিউজের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘সাংবাদিকদের যে বেতন দেওয়া হয়, তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই বলে অনিয়ম করবে তা হবে না। তাহলে কেউ রিকশা চালাত না, সবাই ডাকাতিই করত।’
তবে প্রতিষ্ঠানের আধিক্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাজার ছোট টেলিভিশন বা গণমাধ্যমের সংখ্যা বেশি। অত প্রতিষ্ঠানের দরকার কী?’
কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যখন ৪০টি টেলিভিশন ছিল না, তখন সব মানুষ কী বেকার ছিল? বিকল্প বের হয়ে যায়।’
শুধু ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে নয়, ইদানিং সাংগঠনিকভাবেও উপহার গ্রহণ, পিকনিক বা অনুষ্ঠানের চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক নেতা সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, ‘কল্যাণমূলক বা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো সভা, সেমিনার বা বিনোদমূলক কর্মসূচির প্রয়োজনে অনুদান সংগ্রহ সেটি একরকম। আর যদি ব্ল্যাকমেইলিং বা জোরদবদস্তিমূলক হয়, সেটি অবশ্যই নিন্দনীয় ও অপরাধযোগ্য বিষয়।’
তবে এসবের দৃঢ় প্রতিবাদ করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু। তিনি বলেন, ‘এগুলো নেওয়া মানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) বেড়ে যায়। যখনই আপনি কারো কাছ থেকে সুবিধা নেবেন, তখন আপনি মানসিকভাবে তার কাছে দায়বদ্ধ থেকে যাচ্ছেন। সেই জায়গায় আমি মনে করি এগুলো স্ট্রিক্টলি নিষিদ্ধ করা উচিত। আমরা চাঁদা দিয়ে যাব, চাঁদা দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলে অফিসকে বলা যেতে পারে। আপনি যখন বাইরের অফিস থেকে নেবেন, সেটি আপনার আচরণবিধির লঙ্ঘন। সংগঠনগুলো কাজটি করে সাংবাদিকদের নৈতিকতাবিরোধী কাজ করছে। এ ধরনের সুবিধা নেব না বলে আচরণবিধি তৈরি করা দরকার। রাষ্ট্রের কাছ থেকে নেওয়া যায়, রাষ্ট্রের টাকা মানে জনগণের টাকা। সরকারের দায়িত্ব পেট্রোনাইজ করা।’
এসএন/এসএ/