বাণিজ্য সংগঠনগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে পারবে সরকার!
জাতীয় সংসদে গত ৫ এপ্রিল সংসদে বাণিজ্য সংগঠন বিল-২০২২ পাস হয়েছে। এই আইন অনুসারে সরকার চাইলে যে কোন বাণিজ্যিক সংগঠনের নির্বাহী কমিটি ভেঙে দিয়ে প্রশাসক বসাতে পারবে।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি বা ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (এফবিসিসিআই), বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ), ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই), ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ এর মতো সংগঠনগুলোর পরিচালনা পর্ষদও ভেঙে দিতে পারবে বলে আইনজ্ঞরা জানিয়েছেন।
আইনটা পাস হওয়ার পর ঢাকাপ্রকাশ দুইজন বিশিষ্ট আইনজীবীর মতামত সংগ্রহ করে। তারা আইনটি পর্যালোচনা করে জানিয়েছেন ‘ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এমনিতেই নিয়ন্ত্রিত ছিল, নতুন আইন দ্বারা সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও পোক্ত করা হল। এই আইন বাস্তবায়ন হলে অনেকেই মুক্তভাবে কথা বলার অধিকার হারাবেন বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
পাস হওয়া আইনে বলা হয়েছে ‘কোনও বাণিজ্য সংগঠন অথবা ফেডারেশনের আবেদন বা অভিযোগের প্রেক্ষিতে অথবা সরকারের স্বীয় বিবেচনায় কোনও নিবন্ধিত বাণিজ্য সংগঠন বা তার কোনও শাখা বা দফতরের কার্যক্রম, ব্যবসা, শিল্প, বাণিজ্য বা সেবা খাতের স্বার্থে সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না মর্মে সরকারের কাছে প্রতীয়মান হয়, এই ক্ষেত্রে সরকার লিখিত আদেশ দ্বারা বাণিজ্য সংগঠনের নির্বাহী কমিটি বা পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করতে পারবে। বাতিল করার পর এক বছরের জন্য সরকার একজন প্রশাসক নিয়োগ করতে পারবে।’
বাণিজ্য সংগঠনের নির্বাহী কমিটি বা পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার যে ক্ষমতা আইনে দেওয়া হয়েছে, তাতেই ব্যক্তি অধিকার খর্ব হওয়ার আশঙ্কা করেছেন অনেকে। কারণ সরকারের কাছে প্রতিয়মান হয় সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না এ কথা দিয়ে ভিন্নমত প্রকাশকারী যে কেউ ফেঁসে যেতে পারেন। ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা সরকারের সমালোচনা করার সাহস হারাবে। ভয়ে অনেকে কথা বলতে চাইবে না বলে মনে করেন আইনজীবীরা।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘সংগঠনগুলো সাধারণত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা চলত। জেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনের মতো এখানেও প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা দিচ্ছে সরকার। এটা গণতান্ত্রিক ধারার বিপরীত অবস্থান।’ তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি তো এমনিতেই ছিল। আইন দ্বারা আরও পোক্ত করা হল। আর আইনের অন্যান্য বিধিগুলো আগে থেকেই ছিল। এই আইনের আওতায় বিজিএমইএ ও এফবিসিসিআই চলে আসবে।
প্রায় একই কথা বলেন আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘বাণিজ্য সংগঠনগুলোতে প্রশাসক নিয়োগের বিধান ধ্বংসাত্নক হবে। আমলা দিয়ে সব সমাধান করার চিন্তা। এতে বাণিজ্য সংগঠনগুলো দিন দিন ধ্বংস হবে।’
পাস হওয়া আইনে যা আছে
বাণিজ্য সংগঠনকে সরকারের কাছ থেকে সনদ ও নিবন্ধন নিতে হবে। বাণিজ্য সংগঠন ছাড়া কোনো সংগঠন বা কোম্পানি ‘ফেডারেশন’, ‘চেম্বার’, ‘কাউন্সিল’, ‘গ্রুপ’, ‘এলায়েন্স’ শব্দ ব্যবহার করতে পারবে না। কোনো বাণিজ্য সংগঠন অথবা ফেডারেশনের আবেদন বা অভিযোগের প্রেক্ষিতে অথবা সরকারের স্বীয় বিবেচনায় কোনো নিবন্ধিত বাণিজ্য সংগঠন বা তার কোনো শাখা বা দপ্তরের কার্যক্রম, ব্যবসা, শিল্প, বাণিজ্য বো সেবাখাতের স্বার্থে সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না মর্মে সরকারের কাছে প্রতীয়মান হয়, এই ক্ষেত্রে সরকার লিখিত আদেশ দ্বারা বাণিজ্য সংগঠনের নির্বাহী কমিটি বা পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করতে পারবে। বাতিল করার পর এক বছরের জন্য সরকার একজন প্রশাসক নিয়োগ করতে পারবে।
আইনে প্রতিটি জেলায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা চেম্বার গঠনের সুযোগ রাখা হয়েছে নতুন এ আইনে। এ ছাড়া বাণিজ্য সংগঠনে নারী উদ্যোক্তদের লাইসেন্সের মাধ্যমে সদস্য হওয়ার আইনি ভিত্তির বিধান রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে এমন কোনো দেশ বা অঞ্চলে ব্যবসা শিল্প বা বাণিজ্য ও সেবা খাতে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যৌথ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং একাধিক যৌথ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সমন্বয়ে গঠিত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি জোটের বিধান রাখা হয়েছে বিলে। সেক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত সাপেক্ষে অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে এসে বিদেশি ব্যবসায়ীরা একটি যৌথ চেম্বার করতে পারবেন।
কোনো ব্যক্তি ট্রেড লাইসেন্সে উল্লেখ করা ব্যবসার শ্রেণি ছাড়া অন্য কোনো শ্রেনির সংগঠনের সদস্য হতে পারবেন না। এবং ট্রেড লাইসেন্সে উল্লেখ করা জেলা বা মেট্রোপলিটন চেম্বার ছাড়া অন্য কোনো চেম্বারেরও সদস্য হওয়া যাব না।
প্রত্যেক নাগরিকের সংগঠন করার অধিকার সংবিধানই দিয়েছে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে।
এদিকে, পাস হওয়া আইনকে স্বাগত জানিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমরা যা যা চেয়েছি মোটামুটি সব আছে আইনে। এরপরও যদি সংগঠনের বিরোধী কিছু থাকে তাহলে আমরা পরে আলোচনা করে জানাব। আগে আইন ছিল না এখন আইন হয়েছে। এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ।’
নির্বাহী কমিটি বা পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতাকেও স্বাভাবিক মনে করেন তিনি। পরিচালনা পর্ষদ এর জন্য একটা কমপ্লায়েন্স থাকা দরকার। সেটা এই আইনে রাখা হয়েছে, যোগ করেন তিনি।
এসএম/