পঞ্চবটি-মুক্তারপুর এলিভেটেড সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে অনিয়ম
নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি থেকে মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ এবং এলিভেটেড সড়ক (দোতলা সড়ক) নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্মাণকাজের অভিজ্ঞতা নেই এমন একটি চায়না প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগ উঠেছে, চীনের শ্যানডং লুকিয়াও গ্রুপ কোস্পানি লিমিটেড (এসডিএলকিউ) এবং শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক এন্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ লিমিটেড (সিএসআই) নামের ওই প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ এবং একটি এলিভেটেড সড়ক নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেছে সেতু বিভাগ। এই প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ২৪২ কোটি ৭৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। সরকার এবং সেতু বিভাগের নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ১ জানুয়ারি ২০২১ সাল থেকে ৩০ জুন ২০২৫ সাল পর্যন্ত।।
এই প্রকল্পের জন্য সর্বনিন্ম দরদাতা হিসেবে চীনের শ্যানডং লুকিয়াও গ্রুপ কোস্পানি এবং শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক এন্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ লিমিটেডের সঙ্গে সম্প্রতি নির্মাণকাজের চুক্তি করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। চুক্তি অনুযায়ি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এক হাজার ২০৬ কোটি ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৩৫৬ টাকায় সড়ক প্রশস্তকরণ এবং এলিভেটেড সড়ক নির্মাণ কাজ করবে।
এই প্রকল্পের আওতায় পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত ১০ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার এ্যা-গ্রেড সড়ক প্রশস্তকরণ, ৯ দশমিক ০৬ কিলোমিটার এলিভেটেড সড়ক নির্মাণ (যারমধ্যে র্যাম্প হচ্ছে ২ দশমিক ৮০৫কিলোমিটার), ১৭ দশমিক ৬১ কিলোমিটার ড্রেন, চারটি টোল প্লাজা এবং পাঁচটি ওজন স্কেল নির্মাণ করবে শ্যানডং।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সেতু বিভাগ 'এক ধাপ দুই খাম' পদ্ধতিতে’ দরপত্র আহ্বান করেছিল গত বছরের ৮ মার্চ। সেখানে দেশি-বিদেশি ১৪টি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছিল। এরমধ্যে তিনটি বাংলাদেশি কোম্পানির একটি জেভি, কোরিয়া-বাংলাদেশের একটি জেভি, চীনের দুটি কোম্পানি এককভাবে, চীন-বাংলাদেশের চারটি জেভি এবং চীনের ১২টি কোম্পানি ছয়টি জেভি গঠন করে অংশ নেয়।
১৪টি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে দরপত্রটি প্রতিযোগিতামূলক হলেও সাত সদস্যের দরপত্র কমিটি মূল্যায়ন করে কারিগরিভাবে ১০ দরদাতাকে অযোগ্য ঘোষণা করে। বাকি চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বনিন্ম দরদাতা হিসেবে চীনের শ্যানডং লুকিয়াও গ্রুপ কোস্পানি এবং শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক এন্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ লিমিটেডকে কাজ দেওয়া হয়।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য ও অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ‘একধাপ দুই খাম ‘ পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করলেও ১৪ দরদাতার সিলগালা আর্থিক প্রস্তাব বিবিএ এর হেফাজতে ছিল। সিআইসি ও জেভি অংশীদার শ্যানডং লুকিয়াও গ্রুপকে সর্বনিন্ম দরদাতা দেখিয়ে কাজ পাইয়ে দিতে আর্থিক প্রস্তাব খুলে যাদের দর এক হাজার ২০৬ কোটি টাকার নিচে পাওয়া গেছে তাদেরকে কারিগরি মূল্যায়নে নানান কারণ দেখিয়ে অযোগ্য করা হয়েছে।
জানা গেছে, চীনের সিএসসিএসি, সিআরসিসি-সিসিইসিসি জেভি এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশের হানিল-সিপিসি জেভি দরপত্রের সকল শর্ত পূরণ করলেও তাদেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার সনদ’ সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ মিশন থেকে সত্যায়িত করেনি এই অজুহাতে।
অথচ এই প্রতিষ্ঠানটি মালয়েশিয়ায় ১১ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি দুই লেন সমুদ্র অতিক্রমকারী সেতু নির্মাণের অভিজ্ঞতা সনদ দিয়েছিল কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে। কিন্তু মূল্যায়ন কমিটি তাদেরকে বাদ দিয়েছে এই বলে যে, তারা চীনের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা সনদ এনডোর্সমেন্ট করেনি বলে।
কিন্তু দরপত্র দলিলের আইটিটি বা দরদাতাদের প্রতি নির্দেশের ১৮ এর ২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের না হলে সনদ ইংরেজিতে অনুদিত ও সংশ্লিষ্ট দূতাবাস থেকে সত্যায়িত হতে হবে। গত বছরের ৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত প্রাক-দরপত্র সভায় বিবিএ একটি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিল, ‘বিদেশি দরদাতাদের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার সনদ সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস বা বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস থেকে সত্যায়িত হতে হবে’।
অভিযোগ উঠেছে, দরপত্রের অংশগ্রহণের বিষয়ে বিবিএ কর্তৃপক্ষ যেসব শর্ত দিয়েছিল তার অধিকাংশই মূল্যায়ন কমিটি লঙ্ঘন করেছে।
দরপত্র দলিলের ৬৬ এর ১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ি সিদ্ধান্তের সাত দিনের মধ্যে দরদাতাকে বাতিলের নোটিশ দেয়ার নিয়ম থাকলেও বিবিএ বাতিল হওয়া ১০ দরদাতাকে কোন নোটিশ দেয়নি। আর যারা চিঠি দিয়ে বিবিএ এর কাছে বাতিলের কারণ জানতে চেয়েছে তারাও কোন জবাব পায়নি।
অভিযোগ উঠেছে, দরদাতার আর্থিক যোগ্যতা যাছাইয়ের বার্ষিক গড় লেনদেন ৫০০ কোটি টাকা বা সাড়ে নয় কোাটি ডলার প্রমাণ হিসেবে সাম্প্রতিক বা শেষ তিন বছরের অডিট রিপোর্ট প্রদানের কথা। অর্থাৎ ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালের অডিট রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা থাকলেও বিবিএ এর চাহিদা অনুযায়ি কয়েকটি কোম্পানি অডিট রিপোর্ট জমা দিলেও শ্যানডং লুকিয়াও গ্রুপ ও সিএসআই জমা দিয়েছে ২০১৭,২০১৮ ও ২০১৯ সালের রিপোর্ট। এমনকি শ্যানডং সরকারি খাত থেকে প্রাপ্ত বিলের সত্যায়িত সনদসহ নির্মাণ খাতের বার্ষিক টার্নওভার জমা দিতে পারেনি।
তাছাড়া অডিট রিপোর্ট অনুযায়ি চায়না শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল হচ্ছে প্রকৌশল কোম্পানি। এটি যে প্রকৃত নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সে রকম কোন তথ্য তাদের জমা দেওয়া অডিট রিপোর্টে উঠে আসেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চায়না শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক এন্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ লিমিটেড(সিআইসি) মূলত এক্সপ্রেসওয়ের ব্যবস্থাপনা বা টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠান। এটি কোন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান না হলেও পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়ক প্রশস্তকরণ এবং এলিভেটেড সড়ক নির্মাণের মত একটি বড় কাজ তাদের হাতেই তুলে দিয়েছে বিবিএ।
এসব অভিযোগ এবং চায়না শ্যানডং এর বিষয়ে জানতে চাইলে পঞ্চবটি-মুক্তারপুর প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিক বুধবার ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, এসব অভিযোগ সঠিক নয়। কারণ ১৪টি প্রতিষ্ঠানের দরপত্র মূল্যায়ন করে ১০টি বাদ দেওয়া হয়েছে। তারপর বাকি চারটি থেকে সর্বনিন্ম দরদাতা হিসেবে চায়না শ্যানডংকে কাজ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেওয়া হয়েছে তারা দরপত্রের ক্র্যাইটেরিয়া পূরণ করতে পারেননি।
শফিক বলেন, সাত সদস্যের একটি অভিজ্ঞ মূল্যায়ন কমিটি দরপত্রগুলো মূল্যায়ন করেছে। এসব অভিযোগ আমলে নেওয়ার সুযোগ নেই। এখানে কারচুপির কোন সুযোগ নেই।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, শ্যানডং সম্পর্কে আমরা ব্যাপক খোঁজ নিয়েছি। তারা একটি ভালো প্রতিষ্ঠান। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতেও তারা নির্মাণকাজ করছে।
প্রকল্প পরিচালকের কথার সূত্র ধরে ঢাকাপ্রকাশ শ্যানডং সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিল। তাতে জানা যায়, চায়না শ্যানডং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেওয়ের নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি আর্থিক অংশিদার প্রতিষ্ঠান। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে তাদের আর্থিক বিনিয়োগ রয়েছে ৩৪ শতাংশ। আবার তারা যে এই শেয়ার নিয়েছে সেটিও সরকারের অনুমোদন ছাড়া নিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। তাছাড়া এখানে তারা কোন নির্মাণকাজ করছে না। নির্মাণ কাজের সঙ্গে তাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই বলে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে
এনএইচবি/কেএফ/