মতিঝিলে ধারাবাহিক খুন! পরবর্তী টার্গেট কে?
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে একের পর এক খুন হচ্ছে অনেকেই। সম্প্রতি এ খুনের সংখ্যা বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। অপরাধ বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, মতিঝিল নিয়ন্ত্রণকারী গ্যাং মিল্কি, রিজভি হাসান বাবু ও টিপু হত্যার পর পরবর্তী টার্গেট কে?
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, মতিঝিল নিয়ন্ত্রন মানে পুরো ঢাকা নিয়ন্ত্রণ। মতিঝিল কেন্দ্রিক চাঁদাও উঠে মাসে কোটি টাকার উপরে। শুধু কি চাঁদা? বিভিন্ন টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণও এখান থেকে। আর নিয়ন্ত্রণ নিতেই একের পর এক নেতার উত্থান। আর এসব নেতারাও টিকতে পারছেন না। এক সময়ের ঢাকা কাঁপানো শীর্ষ সন্ত্রাসীরা তাদের কথা না শুনলেই দেশের বাইরে থেকেই নিখুঁত পরিকল্পনায় হত্যা করে যাচ্ছে। গত ৭/৮ বছরে মতিঝিল কেন্দ্রিক আন্ডারওয়ার্ল্ডের ঝামেলায় খুন হয়েছে তিন নেতা।
এছাড়াও বাড্ডার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহাবুবুর রহমান গামাসহ ৪ হত্যার পেছনেও একই আন্ডারওয়ার্ল্ড কাজ করেছে। যার কারণে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে এখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নেতারা বলছেন, ধারাবাহিক হত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে। এখন পরবর্তী টার্গেট কে সেটাই দেখার অপেক্ষা।
টিপু হত্যাকান্ডে আতঙ্কিত ঠিকাদারী ব্যবসায়ীরা
একটি তথ্য বলছে, টিপু হত্যাকান্ডের পর সারাদেশে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, শাহাজানপুর, রামপুরা আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ স্বেচ্ছাসেবক লীগের অনেক নেতারাই আতঙ্কিত। বিশেষ করে যে সকল নেতারা ঠিকাদারী ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা আরও বেশি আতঙ্কিত।
মতিঝিল কেন্দ্রিক রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ঝড়
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন নেতা জানান, জাহিদ হাসান মিল্কি হত্যাকান্ডের পর থেকে মতিঝিল কেন্দ্রিক রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একটি ঝড় বয়ে গেছে। মিল্কি হত্যার পরে জাহিদ সিদ্দিকি তারেক র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়। এরপর মতিঝিলের নিয়ন্ত্রণ কে নেবে তা নিয়ে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। মিল্কি হত্যার পর টিপুসহ অনেক নেতাই যখন আসামি, আবার অনেকে গ্রেপ্তার হয়ে জেলখানায় ঠিক সেই সময় সম্রাট সেই জায়গা দখলে নেয়।
এরপর মতিঝিল নয়, পুরো দক্ষিণ মহানগরে সম্রাটের একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হয়। এক পর্যায়ে আধিপত্যের মাত্রা এমন হয়ে যায় শুধু দক্ষিণের নয়, উত্তর দক্ষিণের একক আধিপত্য চলে আসে তার নিয়ন্ত্রণে। রাজধানী জুড়ে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু হলে সম্রাট, খালেদ গ্রেপ্তার হলে আবারও শুরু হয় আধিপত্যের লড়াই।
এই এলাকায় রাজনীতি করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, মিল্কি মার্ডারের পর থেকে মূলত শুরু হয়েছে আধিপত্যের লড়াই। মিল্কি হত্যার সঙ্গে জড়িতরা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে বোচা বাবু হত্যাকান্ড ঘটে। সর্বশেষ টিপু হত্যাকান্ড সংঘঠিত হয়।
বিভিন্ন রাজনৈতিক সূত্র বলছে, টিপু হত্যাকান্ডের পর সম্রাট ও খালেদের কাছেও খবর পৌঁছে যায়। বর্তমানে এ এলাকার আধিপত্য নিতে কারাগারে থাকা সম্রাট, খালেদ এমনকি গোল্ডেন মনিরের কাছে অনেকেই ধর্না দিচ্ছে।
যা বলছে যুবলীগ নেতারা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুবলীগের এক নেতা বলেন, দক্ষিণ যুবলীগের মধ্যে মতিঝিল, পল্টন, শাহজাহানপুর এলাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক নেতা ঠিকাদারী কাজ করেন। বড় কোন কাজ হলেই এই তিন থানা এলাকার ছোট নেতা হলেও তাদের সমিহ করে টাকা দিতে হয়। তা না হলে করুন পরিনতি ভোগ করতে হবে।
বর্তমান যুবলীগের কেন্দ্রীয় আরেক নেতা বলেন, সম্রাট-খালিদও একই পথ অবলম্বন করত। বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের নামে চাঁদা উঠতো। পাশাপাশি ক্যাসিনো থেকেও উঠতো টাকা। এই টাকাও তাদের দুবাইসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশি পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিকট বিভিন্ন মাধ্যমে পৌঁছে দিতে হত।
এদিকে মিল্কি, বোঁচা বাবু হত্যার পর সম্রাট-খালিদ ম্যানেজিং এর কাজটি ভালোভাবেই করত। এ কারণে তাদের সমস্যাও হয়নি। কিন্তু ক্যাসিনো কান্ডে তারা গ্রেপ্তার হয় এবং কারাগারে রয়েছে।
যুবলীগের বেশ কিছু নেতা বলছেন, সম্রাট একবার অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। ওই সময় আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার ঝামেলা বাধে। ওই সময় হাসপাতালে থাকা অবস্থায় তাকে হত্যা করতে কিলার ভাড়া করে পাঠানো হয়। অল্পের জন্য বেঁচেও যায় সে। তবে গ্রেপ্তার হয়ে সম্রাট খালেদ জেলহাজতে থাকায় টিপু অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে চেয়েছিল।
টিপুর হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার এরপর যা বলছে গোয়েন্দারা
এদিকে র্যাব জানায়, ২০১৩ সালে রাজধানীর গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে মিল্কী হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয়। টিপু হত্যায় গ্রেপ্তারকৃত ওমর ফারুক (৫২), আবু সালেহ শিকদার (৩৮), নাছির উদ্দিন (৩৮) ও মোরশেদুল আলম (৫১)। গ্রেপ্তারকৃতরা মিল্কীর সহযোগী ছিল। মিল্কী হত্যার সঙ্গে টিপু জড়িত ছিল বলে গ্রেপ্তারকৃতরা সন্দেহ করত।
মিল্কী হত্যার মামলার এজহারে টিপুর নামও দেয় তারা। কিন্তু বিচারিক কার্যক্রমে টিপুর নাম বাদ পড়ায় গ্রেপ্তারদের মনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
দীর্ঘদিন ধরে ভিকটিম ও হত্যার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বিরোধ ছিল উল্লেখ করে র্যাব জানায়, মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তি বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিল। এছাড়া এলাকার আধিপত্য বিস্তারসহ মামলা সংক্রান্ত বিষয়েও টিপুর সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃতদের দ্বন্দ্ব ছিল। আর এসব দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করেই টিপুকে হত্যা করা হয়।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেছেন, টিপুকে হত্যা করার জন্য ১৫ লাখ টাকা বাজেট করে পরিকল্পনাকারীরা। আন্ডার ওয়ার্ল্ড ডন মুসাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এ হত্যাকাণ্ডে। ঘটনার ১২ দিন আগে মুসা দুবাই চলে যায়। সেখানে বসে তিনি কিলার নিয়োগ করা থেকে শুরু করে হত্যার ফাইনাল মিশন শেষ করে।
এর আগে টিপু-প্রীতি হত্যাকাণ্ডের ৪৮ ঘণ্টা পর মো. মাসুম ওরফে আকাশ নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের মতিঝিল বিভাগ। পুলিশ বলছে, মাসুমই ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে টিপুকে গুলি করে হত্যা করে।
যে ভাবে দুবাই বসেই ফাইনাল ছক করে মুসা
গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যানুসারে, টিপুকে দুবাই বসে হত্যার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দেন সুমন শিকদার ওরফে মুসা। টিপু হত্যাকাণ্ডের ঠিক ১২ দিন আগে দুবাই চলে যায় মুসা। দুবাই বসে হত্যার পুরো ছক কষে। টিপুকে হত্যায় চুক্তি হয় ১৫ লাখ টাকা। এই ১৫ লাখ টাকা কে কত দেবে তাও ভাগ করে দেয় মুসা। নয় লাখ টাকা দেয় ওমর ফারুক। অবশিষ্ট ছয় লাখ টাকা দেয় গ্রেপ্তার নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ ও মুসা।
খন্দকার আল মঈন জানান, দুবাই যাওয়ার আগে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে যায় মুসা, হুন্ডির মাধ্যমে আরও চার লাখ টাকা মুসাকে দেওয়া হয়। বাকি ছয় লাখ টাকা দেশে হস্তান্তর করার চুক্তি হয়। ছয় লাখের মধ্যে গ্রেপ্তারের সময় ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা জব্দ করে র্যাব। দুবাই থাকা মুসা ২০১৬ সালে রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবু হত্যাকাণ্ডের চার্জশিটভুক্ত ৩ নম্বর আসামি।
দেশে হত্যাকাণ্ড হলেও নিয়ন্ত্রণ হয় বাইরে থেকে
গ্রেপ্তারদের বারাত দিয়ে র্যাব কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছেন, এ হত্যাকাণ্ডটি দেশে ঘটলেও নিয়ন্ত্রণ করা হয় দুবাই থেকে। দেশে থাকা নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশসহ আরও কয়েকজন জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে বেশ কয়েকদিন ধরে মুসার কাছে তথ্য প্রেরণ করত। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর গ্রেপ্তার নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির আনুমানিক চারবার জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে অবহিত করে। পরে জাহিদুল ইসলাম টিপু গ্রান্ড সুলতান রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় গ্রেপ্তার মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ তাকে নজরদারিতে রাখে এবং তার অবস্থান সম্পর্কে ফ্রিডম মানিককে অবহিত করে। টিপুর অবস্থান সম্পর্কে জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টার দিকে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের তত্ত্বাবধানে কিলার কর্তৃক হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়।
টিপু হত্যার পর চরম আতঙ্কে মতিঝিল সিন্ডিকেট
এদিকে টিপু হত্যাকান্ডের পর স্থানীয় নেতারা চরমভাবে আতঙ্ককিত। তারা বলছে, হত্যাকান্ডের মূল বিষয় হলো আধিপত্য আর চাঁদাবাজি। সন্ত্রাসীরা এতটাই বেপরোয়া চাঁদা না দিলেই গুলি করে দেবে। নেতারা বলছেন, পরিস্থিতি এখন উত্তপ্ত। কিছুদিন পর হয়তো ঠিক হবে। কিন্তু এখন চলাফেরা করাই দায় হয়ে পড়েছে।
টিপু হত্যায় মতিঝিল রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের একটি বিশ্বস্ত তথ্য বলছে, জীবনের থেকে টাকা বড় নয়। পরিস্থিতি হয়তো এক সময় স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে সবাই নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। মতিঝিল সিন্ডিকেটের দাবি, সবাই যদি মিলেমিশে না চলে তাহলে এমন নির্মম ভাবে আরও অনেককেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হবে।
হঠাৎ সারা দেশের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হচ্ছে কেন এর সমাধান কি এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, মানুষ যতদিন লোভ লালসা থেকে বের হয়ে না আসতে পারবে ততদিন এমন মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকবে। বর্তমানে মানুষের প্রতি মানুষের মায়া-মমতা নাই এজন্য আরো বেশী অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, যারা সততার সাথে বিগত দিনের রাজনীতি করেছেন তারা কিন্তু কেউ এ ধরনের নির্মম খুনের শিকার হননি। যারাই সন্ত্রাসের রাজত্ব করেছে সাংগঠনিকভাবে সন্ত্রাসীদের নেতৃত্ব দিয়েছে তারাই এমন হত্যাকাণ্ডের সম্মুখীন হয়েছে।
মানুষ সততার সাথে রাজনীতি এবং ব্যবসা বাণিজ্য করলে হয়তো এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা কমে আসবে বলে মনে করেন এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ।
কেএম/এএস