সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচন: সমাধান কোন পথে?
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সংবিধান অনুসারে সংগঠনটির কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ ছিল গত বছরের পয়লা এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। সেই হিসেবে কমিটির ২০২১-২২ সেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ ফুরিয়েছে আরও একদিন আগে। কিন্তু ২০২২-২৩ সেশনের কমিটি গঠনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এখনো ফল ঘোষণা হয়নি। গত ১৫ ও ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়া ওই নির্বাচনের ফল ঘোষণা নিয়ে চলছে অনিশ্চয়তা।
তবে ২০২১-২২ সেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস মনে করেন, তাদের কমিটির মেয়াদ এখনও আছে। ঢাকাপ্রকাশকে তিনি বলেন, সমিতির সংবিধান অনুযায়ী এই মেয়াদকাল হলেও প্রতি বছর যেটি হয়ে আসছে, তা হচ্ছে এজিএমে (বার্ষিক সাধারণ সভা) নতুন কমিটির কাছে এক বছরের জন্য দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়। গত বছর ১২ এপ্রিল এজিএম হয়। সেদিন আমরা এক বছরের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করি। সে হিসেবে আমাদের কমিটির মেয়াদ আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত আছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে গত বুধবার (৩০ মার্চ) দীর্ঘ বৈঠক করেছে বারের কার্যনির্বাহী কমিটি। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সাত দিনের মধ্যে বারের সাবেক সভাপতি ও সম্পাদকরা বৈঠক করবেন। ওই বৈঠকেই ফলাফল ঘোষণার বিষয়ে চলমান জটিলতার অবসান ঘটবে। সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ও সম্পাদকদের চিঠি দেওয়ার কাজ শুরু হবার কথা বৃহস্পতিবার থেকেই। তবে গতকাল শুক্রবার রাতে অন্তত চারজন সাবেক সভাপতির সঙ্গে কথা হয় ঢাকাপ্রকাশের। তাদের কেউ এখন পর্যন্ত চিঠিই পাননি বলে জানান।
দুই দিনব্যাপী ওই নির্বাচনের দ্বিতীয় দিনে গত ১৬ মার্চ রাতে ফল ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু সম্পাদক পদে ভোটের হিসাব নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় সেই ফল এখনও ঘোষণা করা হয়নি।
এই বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বারের সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, আমি তো সিনিয়র, আগাম মতামত দেওয়া ঠিক হবে না। এখনও চিঠি পাইনি। চিঠি পেলে মতামত দেব।
বারের সাবেক সভাপতি ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যরিস্টার শফিক আহমেদ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ফল ঘোষণায় একদিনও দেরি করা ঠিক হয়নি।
তিনি বলেন, সম্পাদক পদের উভয় পক্ষ যদি এই নির্বাচন না মানে, তাহলে অন্য সব পদের ফলাফল তো ঘোষণা করে দেওয়া যায়। দায়িত্ব নেয়ার পর নতুন কমিটি যদি মনে করে বিতর্কিত সাধারণ সম্পাদক পদ ফাংশান করবে না, তাহলে করবে না। আর তারা যদি মনে করে এই পদে পুনরায় ভোট হতে পারে।
বারের আরেক সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনও চিঠি পাননি বলে জানান তিনি। ঢাকাপ্রকাশকে তিনি বলেন, দেশের সবগুলো প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এখানে (সুপ্রিম কোর্ট বার) কখনো ইলেকশনে হেরে গিয়ে রিকাউন্টিংয়ের দাবি তোলা হয়নি। একে কেন্দ্র করে যা হয়েছে, এটা নেক্কারজনক ঘটনা। তারা নির্বাচন উপকমিটির সঙ্গে অসম্মানজনক আচরণ করেছে, তাদের অপমান করেছে। এর প্রেক্ষিতে উপকমিটির আহ্বায়ক পদত্যাগ করেছেন। তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি। এখন উপকমিটিকে অনুরোধ করে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করার ব্যবস্থা করা দরকার। এছাড়া আর কোনও গতান্তর আমি দেখি না।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এর আগে একবার সুপ্রিম কোর্ট বারের এক নির্বাচনে আবদুল মতিন খসরু (প্রয়াত সাবেক আইনমন্ত্রী ও বারের সাবেক সভাপতি) রিকাউন্টিংয়ের আবেদন করেছিলেন, সেটি নাকচ হয়েছিল। কারণ বারের গঠনতন্ত্রে রিকাউন্টিংয়ের বিধান নেই।
বারের আরেক সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচনের ফল ঘোষণা নিয়ে এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। রিকাউন্টিংয়ের বিধান আমাদের গঠনতন্ত্রে নেই।
বিধান না থাকলেও নজির আছে। বর্তমান রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন রিকাউন্টিং করিয়ে একবার বারের সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন-এই উদাহরণ মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, রিকাউন্টিংয়ে নূরুল ইসলাম সুজন ২ ভোটে জিতেছিলেন। যাই হোক, আমি এখন কোন মতামত দেব না।
চিঠি না পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যখন আমরা বৈঠকে বসব, তখন সেখানে মতামত দেব।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, চলমান জটিলতার অবসান কীভাবে হবে, সেটা কমিটি বসে ঠিক করবে। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও পরবর্তী কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত বর্তমান কমিটি কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদত্যাগ করায় কমিশনের অন্য সদস্যদের মধ্য থেকে একজন বা নতুন করে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া যাবে।
প্রসঙ্গত, গত ১৭ মার্চ দিবাগত রাত ১টার দিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনের ভোট গণনা করা হয়। তাতে দেখা যায় যে সভাপতিসহ ৬টি পদে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সাদা প্যানেল এগিয়ে। আর সম্পাদকসহ ৮টি পদে বিএনপি-সমর্থিত নীল প্যানেল। ওই সময় নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণার প্রস্তুতি নিলেও সম্পাদক পদে ভোট পুনরায় গণনার দাবি তোলেন আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা। ভোট গণনার সময় আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের সাদা প্যানেলের প্রার্থী আব্দুন নূর দুলালের সমর্থকরা কিছু নষ্ট হওয়া ভোট তাদের প্রতিপক্ষ নীল প্যানেলের প্রার্থীর পক্ষে গণনা করা হয় বলে অভিযোগ করেন। এর প্রেক্ষিতে তারা সম্পাদক পদে ভোট রিকাউন্টিংয়ের আবেদন করেন। রিকাউন্টিং না করায় তারা নির্বাচন পরিচালনায় গঠিত উপকমিটির আহ্বায়ক এ ওয়াই মশিউজ্জামানের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন বলেও অভিযোগ ওঠে। পরে আহ্বায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করেন মশিউজ্জামান। ফলে আটকে যায় ভোটের ফল ঘোষণা।
ভোট গণনায় সভাপতি পদে এগিয়ে থাকা মমতাজ উদ্দিন ফকির ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, পয়লা এপ্রিল থেকে নির্বাচিতদের কাছে দায়িত্ব দিলে ভালো হতো। তবে এখন এই অবস্থায় কী করা হবে তা রুহুল কুদ্দুস সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আব্দুন নূর দুলাল ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, আমরা রিকাউন্টিংয়ের আবেদন করেছি। তবে এটি আসলে রিকাউন্টিং হবে না। কারণ নির্বাচন পরিচালনায় গঠিত উপকমিটির আহ্বায়ক এ ওয়াই মশিউজ্জামানই তখন বলেছিলেন যে গণনাতো শেষ হয়নি, তাই এটি হবে ফ্রেশ কাউন্টিং। পরে তিনি কাউন্ট না করে ভোটের বাক্স বারের সম্পাদকের হেফাজতে রেখে গেছেন। কিন্তু বারের সম্পাদক তো ভোটের একটা পক্ষে, আমার প্রতিপক্ষ আহ্বায়ক, তার কাছেই ভোটের বাক্স রেখে গেছেন। মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় রুহুল কুদ্দুস সাহেব এখন আর বারের সম্পাদকও নন। তবুও আমি চাই গণনা হোক, গণনায় তিনি জিতলে আমি ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেব।
এমএ/এসআইএইচ