ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন!
গত এক দশকে আমূল পরিবর্তন হয়েছে দেশের নৌ পথের যাত্রীবাহী লঞ্চের অবকাঠামোতে। অন্তত ডজনখানেক অত্যাধুনিক, বিলাসবহুল লঞ্চ এসেছে নদী পথে। প্রতি বছরই নতুন নতুন লঞ্চ যুক্ত হচ্ছে যাত্রী সেবায়। তিন-চার তলা বিশিষ্টি এসব লঞ্চে লিফট, এয়ারকন্ডিশন, টিভি ফ্রিজ, সোফাসহ এমন কোনো বিলাসিতা নেই যা লঞ্চের যাত্রী সেবায় যুক্ত করা হয়নি। বর্ণিল আলোকসজ্জায় মুগ্ধ হতে হয় যে কাউকে। কিন্তু সেবার মান নিয়ে প্রশ্নও ওঠেছে। লঞ্চগুলোতে নিরাপত্তা হুমকির মুখে বলে অভিযোগ যাত্রীদের।
সুমাইয়া সাবা নামে এক যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, সম্প্রতি ঝালকাঠিতে একটি লঞ্চ দুর্ঘটনা আমরা দেখেছি। চারদিকে পানি থাকলেও আগুন কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আমাদের বার বার ভাবিয়েছে। আমরা প্রতিটি কেবিনের সামেনে বয়া রাখা আছে দেখলেও অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র নেই।
হাসিবুর রহমান নামের আরেক যাত্রী বলেন, লঞ্চের উপরটা যতটাই ফিটফাট ভেতরটাও নিরাপত্তার দিক দিয়ে ততটাই গোছানো কি না এমন প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। দফায় দফায় ভাড়া বাড়ানো আর ছোট ছোট ঘটনায় ধর্মঘটের ডাক দিলেও সব লঞ্চে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই। অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, বালু, বয়া, বাতি বিকন, লাইফ জ্যাকেট রাখার কথা থাকলেও সব লঞ্চে পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই।
এদিকে শুধু যাত্রীরাই নয় লঞ্চের কর্মচারীরাও ভুগছেন নিরাপত্তা হীনতায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক লঞ্চের কর্মচারিরা অভিযোগের সুরে বলেন, আমরা লঞ্চে ২৪ ঘণ্টাই থাকি। এই চাকরি আমাদের সংসার বাঁচিয়ে রাখছে। তবুও বলতে হয় যাত্রীদের সঙ্গে আমারাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমারা চাই সুষ্ঠু তদারকির মাধ্যমে নিরাপত্তা দেখবালে নিয়োজিত কতৃপক্ষ লঞ্চে নিরাপত্তার বিষয়ে জোড় দিক।
বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, যাত্রী সেবার নামে যেভাবে অর্থ আদায় হয় তার সমপরিমাণ সেবা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। লঞ্চ কতৃপক্ষের গা ছাড়া ভাব দূর করে আরও সচেতন হতে হবে। দুর্ঘটনা ঘটার সবচাইতে বড় কারণ হলো ইঞ্জিনরুমের পাশে চা আর ভাতের দোকান। সেখানে সবসময় আগুন জ্বলতে থাকে। কিছু কিছু লঞ্চে তো লাকড়ি দিয়ে রান্না করা হয়, যা গ্যাসের চেয়েও ভয়াবহ। আমারা চাই লঞ্চ কতৃপক্ষ সচেতন হোক। এর সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও বিআরটিএ তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করুক।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন চৌধুরী বলেন, 'দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দা হিসেবে আমাদের একমাত্র বিশ্বস্ত পরিবহনের নাম লঞ্চ। আজ আমরা সেই লঞ্চেই নিরাপদ না। প্রায়ই চোখ পড়ে লঞ্চে নারীদের লাশ পাওয়া যায়। এখন আগুনকাণ্ড। সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে অনুরোধ থাকবে তারা যেন লঞ্চের নিরাপত্তার বিষয়ে মালিক পক্ষকে চাপ দেয় এবং সকল ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।'
পারাবত ৯ লঞ্চের সুপার ভাইজার মো. বাবুল হোসেন বলেন, 'একটি লঞ্চে যে পরিমাণ নিরাপত্তা থাকা দরকার তা সব আছে। তবে অল্প সমস্যা সব লঞ্চেই থাকে। আমরা অতিদ্রুত সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে অবহিত করে নিরাপত্তার বিষয়ে যদি কোথাও কোনো ভুল থেকে থাকে তা সমাধান করব।'
কুয়াকাটা ২ লঞ্চের ম্যানেজার মো. নাসির উদ্দিন বলেন, 'আমারা সরকার কতৃক নির্ধারিত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যা যা প্রয়োজন সব কিছুই রাখছি। কিন্তু প্রকৃতির ওপর তো আল্লাহ ছাড়া কারও হুকুম চলে না। আমারা চেষ্টা করছি যাত্রীদের নিরাপত্তা দেওয়ার। বাকিটা আল্লাহ ভরাসা।'
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বরিশাল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক মো. বেলাল উদ্দিন বলেন, 'আমরা সবসময় চেষ্টা করছি যাত্রীবাহি লঞ্চগুলো যাতে নিরাপদ থাকে। লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে কথা বলে লঞ্চে কর্মরতদের ইতিমধ্যে বিনামূল্যে বিভিন্ন নিরাপত্তাজনিত প্রশিক্ষণ দিয়েছি। প্রয়োজনে আবারও দেব। এ ছাড়া অতিদ্রুত সকল লঞ্চগুলো আবারও ভিজিট করে নিরাপত্তার বিষয়টি আরও জোরদার করা হবে।'
এদিকে নিরাপত্তার ঘাটতি থাকাতে প্রতি বছরই ঘটছে দুর্ঘটনা। যার সবশেষ সংযোজন ঝালকাঠিতে শাতাধিক মানুষের প্রাণহানি। আরও সচেতন হওয়ার তাগিদ সংশ্লিষ্টদের।
টিটি/