পটুয়াখালীর পায়রা: প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঝলমলে এক জনপদ
পটুয়াখালীর পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘিরে একটি পশ্চাৎপদ জনপদে গত অর্ধযুগে যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে, তা সেখানকার মানুষের স্বপ্নেরও অতীত। যে এলাকা ছিল শহর থেকে শত কিলোমিটার দূরে, সেই এলাকা এখন উন্নত জনপদের রূপ ধারণ করে আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার (২১ মার্চ) বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উদ্বোধন করবেন।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে পাল্টে গেছে পটুয়াখালীর দৃশ্যপট। জাতীয় অর্থনীতির পাশাপাশি কেন্দ্রটি আঞ্চলিক অর্থনীতিতেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। যে কারণে এটিকে কেন্দ্র করে স্থানীয়ভাবে নেওয়া হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
পুরোপুরি অজপাড়া-গাঁর এই এলাকাটি এখন আলো ঝলমলে। ছয় বছর আগেও মানুষ এখানে সড়কের কথাই ভাবতে পারেনি, সেখানে এখন উঠছে বিমানবন্দরের দাবি। মাছ ধরাই ছিল যাদের একমাত্র জীবিকা, এখন তারা অনেক কিছু করে।
ঘরে বিদ্যুৎ আসবে-এই স্বপ্ন দেখতে না পারা মানুষ এখন নিজের চোখেই দেখছে, তাদের এলাকায় উৎপাদিত বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করছে গোটা দক্ষিণাঞ্চল।
যাদের জমিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র, তারা বসবাস করত কুঁড়ে ঘরে। তারা এখন বাস করে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার বাসভবনে। যে এলাকা ছিল শহর থেকে শত কিলোমিটার দূরে, সেই এলাকা এখন উন্নত শহরের রূপ ধারণ করে আছে।
পড়াশোনা করে উন্নত ভবিষ্যৎ গড়া এক সুদূরপরাহত স্বপ্ন ছিল যে শিশু-কিশোরদের, তারা এখন কারিগরি শিক্ষা নিচ্ছে।
এসবকিছু হয়েছে পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে।
২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এ কেন্দ্রের একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে জাতীয় গ্রিডে। তবে আজ সোমবার কেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর শুরু হবে বাণিজ্যিক উৎপাদন।
তবে কেন্দ্রটি আপাতত তার উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক ব্যবহার করবে। যে দুটি সঞ্চালন লাইন তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তার মধ্যে একটি হতে না পারায় অন্য একটি ইউনিটকে বসিয়ে রাখতে হবে চলতি বছরের বাকি সময়। এটুকু বাদ দিলে এই কেন্দ্রটিকে দক্ষিণের জীবন ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রকল্প বললে অত্যুক্তি হবে না।
২০১৬ সালে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের সড়কগুলো ছিল কাদামাটিতে ভরপুর। তখন পাকা রাস্তা ছিল না বললেই চলে। বিদ্যুতের কথা ভাবা তো ছিল কল্পনার মতো। বলতে গেলে ভূতুড়ে এলাকা ছিল গোটা ধানখালী।
ছয় বছর পর পুরো ভিন্ন চিত্র। ধানখালী ইউনিয়নটি এখন শহর হয়ে গেছে। সেখানে এখন চার লেনের সড়ক। রাতের আলোয় মনে হয়, দেশের ব্যস্ততম কোনো শহরের দৃশ্য।
পাঁচ বছর আগে যে মাটির রাস্তায় বাইসাইকেল আর ভাড়ায় মোটরসাইকেল ছিল প্রধান বাহন। সেখানে এখন চার চাকার যানবাহনে ব্যস্ত থাকে ২৪ ঘণ্টা।
গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সামনের রাস্তায় নতুন ইজিবাইক নিয়ে বসেছিলেন চালক সাইফুল ইসলাম। তিনি নৌকা নিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, যেটা ছিল অনেক কষ্টের। সে সময় তার বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। এখন নিজ ঘরে রাতে ইজিবাইক চার্জ দিয়ে সকালে রাস্তায় নামেন যাত্রী আনা-নেওয়ার কাজে।
সাইফুল বলেন, ‘দারুণ লাগছে। জীবনে কল্পনাও করি নাই মোগো এইহানে এত সুন্দর চকচকে এত্ত বড় রাস্তা অইবে। হাজার হাজার বড় গাড়ি এহোন এই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া হরে।’
সোমবারের বাজারের দোকানদার ছোবাহান মিয়া বলেন, ‘মোর দোহানে এহন ফ্রিজও আছে। ভালোই বেচাকেনা অয়। আগে মুইও নদীতে জাল হালাইতাম। মাঝে-মধ্যে মাছ পাইতাম, আবার কহোনো পাইতাম না। সংসার চালাইতে মোর অনেক কষ্ট অইত। কিন্তু এই কেন্দ্রের লাইগ্যা এই এলাকার অনেক উন্নতি হইছে।
‘রাইত ১১-১২ডা পর্যন্ত লোকজন থাহে মোর দোহানে আর আগে এই বাজারে মোরা থাকতাম রাইত ৮টা পর্যন্ত। তহন দোহান ছিল হাতে গোনা দু-চাইরডা। আর এহন দেহেন দোহানের পর খালি দোহান আর দোহান।’
পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী রেদওয়ান ইকবাল বলেন, ‘১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণেই মূলত এ পরিবর্তন। শুধু সড়কই নয়, এখানে গড়ে উঠছে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি। বেড়ে গেছে এখানকার জমির মূল্যও।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যখন প্রথমে ২০১৬ সালে এখানে এসেছি, অনেক নৌকায় পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে। ছোট ছোট খাল ছিল আর ছিল মাইলের পর মাইল বিল। পাকা রাস্তা ছিল না। আর আজ সেখানে ফোর লেনের কাজ সমাপ্তির পথে। এর পরই আবার শুরু হবে সিক্স লেনের কাজ।’
কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা হানিফ চৌকিদারের সঙ্গে। তিনি জানান, এখানকার জমির দাম কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। তবে মূল সড়কের পাশে কোনো খালি জমি নেই। সব বিক্রি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ঢাকার বড় বড় পার্টি এসে কানি কানি জমি কিনছে। এখন সেই সব জমি বালু দিয়ে ভরাটের কাজ চলছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই এসব এলাকায় বড় বড় দালানকোঠায় ভরে যাবে।’
তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শাহ আব্দুল মওলা বলেন, ‘ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে এখানকার অধিবাসীদের। কর্মসংস্থানের সুযোগসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসী নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সুযোগ পাবে এখান থেকে।’
এমএসপি