রংপুরে গত ছয় বছরে দ্বিগুণ হয়েছে রেশম চাষ
রংপুর অঞ্চলে ছয় বছরের ব্যবধানে রেশম চাষ ও সুতা উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। রংপুর অঞ্চলের ঠাকুরগাঁওয়ে রেশম সুতা তৈরি ও সিল্ক কাপড় তৈরির মিল থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জঠিলতার কারণে দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকায় রংপুর আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কার্যালয় রেশম গুটি রাজশাহীতে পাঠাচ্ছে। কারখানাটি চালু থাকলে সিল্কের কাপড় তৈরিতে রংপুর প্রসিদ্ধ হতো এবং কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানে সৃষ্টি হতো বলে মনে করেন রংপুর চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সরোয়ার টিটু।
রেশম চাষে রংপুর এখন রাজশাহী অঞ্চলের ঠিক পরেই অবস্থান করছে। জনবল সংকট সহ নানা সমস্যা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে রংপুরের রেশম শিল্প। বর্তমানে রংপুর অঞ্চলে বছরে প্রায় পাঁচ টন সুতা উৎপাদন হচ্ছে, প্রতি বছরই নতুন নতুন এলাকা লাভ জনক রেশম চাষের আওতায় আনা হচ্ছে। প্রাচীন শিল্পের মধ্যে রেশম শিল্প দেশ ভাগের আগ থেকেই রাজশাহী অঞ্চলে রেশমের চাষ হতো। এখনো এক্ষেত্রে রাজশাহী অঞ্চল এগিয়ে তবে পিছিয়ে নেই রংপুর বিভাগ। রংপুর চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সরোয়ার টিটু সিল্কের কাপড় তৈরি কারখানাটি চালু করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। রেশম চাষের আওতায় চলতি মৌসুমে রংপুর বিভাগের প্রায় একশত হেক্টর জমি আনা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন, রংপুর আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কার্যালয় ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রংপুরের উপপরিচালক মো. মাহবুব-উল হক।
রংপুরের আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কার্যালয় ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১৫ সালে গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও রংপুরে রেশম চাষে যুক্ত ছিলেন প্রায় এক হাজার চাষী। সে সময় প্রতি বছর রেশম গুটি উৎপাদন হতো ৩০-৩৫ হাজার। বর্তমানে চাষীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে তিন হাজারের বেশি এবং রেশম গুটি প্রতি মৌসুমে উৎপাদন হচ্ছে ৫০-৬০ হাজার। এ অঞ্চলের প্রায় ৩ হাজার পরিবার রেশম পোকার চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। যাদের দেখে আরো অনেকে এ কাজে উৎসাহ পেয়েছেন। এমনই একজন রংপুর সিটি করপোরেশনের ১৫ নং ওয়ার্ডের ফতেপুর ভুরাঘাট এলাকার রোখসানা পারভীন। অনেকটা কৌতূহলের বশেই রেশমের চাষ শুরু করেন তিনি। রংপুর রেশম সম্প্রসারণ কার্যালয় থেকে তিনি রেশম (পলু) পোকার ১০টি ডিম, পোকা প্রতিপালনের উপকরণ ডালি, চন্দ্রকী, পোকার এক মাত্র খাবার তুঁত পাতার ছোট-বড় মিলে ৬০০ গাছ বিনামূল্যে সংগ্রহ করেন। ডিম ফোটার পর পোকাগুলোকে এক মাস শুধু তুঁত পাতা খাওয়ানোর মাধ্যমে পাঁচ কেজি রেশম গুটি সংগ্রহ করেন তিনি। ৩০০ টাকা দরে প্রতি কেজি রেশম গুটি বিক্রি করেন।
নগরীর রেশম চাষি রোখসানা বলেন, এখন কেবল তুঁত পাতা সংগ্রহের জন্য ৮ শতক জমিতে তুঁতের চাষ করেছি। ভবিষ্যতে রেশম চাষের পরিমাণ আরো বাড়াতে চাচ্ছি।
রংপুর নগরীর আব্দুল খালেক, নিত্য চন্দ্র বর্মণ, রাজিয়া বেগমসহ অনেকেই এখন রেশম পোকা আবাদ করে বাড়তি আয় করেছেন। তবে এসব চাষি নিয়মিত তদারক করতে পারে না রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্র। মূলত লোকবল সংকটের কারণেই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ কারণে একাধিক জেলার রেশম চাষ তদারকির দায়িত্ব পালন করতে হয় একজন কর্মকর্তাকে। ফলে তার পক্ষেও সবসময় সবকিছু দেখভাল করা সম্ভব হয় না।
রংপুর বিভাগসহ কয়েকটি জেলার দায়িত্বে থাকা রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের ম্যানেজার (সম্প্রসারণ) মো. হাসিবুল ইসলাম বলেন, সংকর (হাইব্রিড) জাতের রেশম পোকা শুধু তুঁত পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। এ গাছের নতুন পাতা হতে সময় লাগে দুই মাস। ডিম থেকে রেশম পোকা বের হওয়া ও গুটি সংগ্রহ পর্যন্ত সময় লাগে এক মাস। তাই বছরে চার বার রেশম চাষ হয়। চাষিরা উৎপাদিত গুটি কেন্দ্রের কাছে বিক্রি করেন। ১০-১২ কেজি গুটি থেকে এক কেজি রেশম সুতা পাওয়া যায়।
রংপুর অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি রেশম নীলফামারী জেলায় উৎপাদন হয় জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, রেশম গুটি উৎপাদন হয় ৮-১০ হাজার কেজি। নীলফামারীর সৈয়দপুর ও কিশোরগঞ্জ উপজেলার অনেক কৃষক আছেন, যারা বছরে রেশম গুটি বিক্রি করে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা আয় করেন।
রংপুর আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কার্যালয় ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রংপুরের উপপরিচালক মো. মাহবুব-উল হক বলেন, রেশম চাষ বৃদ্ধিতে দুটি প্রকল্প কাজ করছে। এর মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি রেশম চাষের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর জেলার দারিদ্র্য হ্রাসকরণ শীর্ষক প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। এতে সুফল ভোগ করছে প্রায় তিন হাজার পরিবার। রেশম চাষের আওতায় এসেছে ৫০০ বিঘা জমি। আবার তিন বছর মেয়াদি বাংলাদেশ রেশম শিল্পের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা ফেজ-২ শুরু হয়েছে চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২)। এর মাধ্যমে রেশম চাষের আওতায় এসেছে ৩৫০ বিঘা জমি। রংপুর বিভাগের ১৬ টি নদ-নদী প্রবাতি অববাহিকার জেলা কুড়িগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা রেশম চাষের আওতায় নতুন করে আনা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন।
তিনি আরো বলেন, রেশম চাষ বৃদ্ধির লক্ষে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় ৬ লাখ ৪ হাজার তুঁত চারা বিতরণ করা হয়েছে। নতুন ১১৭ জন চাষিকে এক বিঘা করে জমিতে তুঁত গাছ আবাদের মাধ্যমে রেশম চাষের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। গড়ে তোলা হচ্ছে আইডিয়াল রেশম পল্লী, রেশম ব্লক। এছাড়া আগ্রহী চাষীদের দেয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ। রেশমচাষীদের সব উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। দক্ষ চাষিদের রেশম চাষের জন্য ঘর তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। তাদের উৎপাদিত গুটি মানভেদে কেজি প্রতি ৩০০-৪০০ টাকা দরে কিনে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। লোকবল সংকটের কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিশ্রম বেড়ে গেছে বলে জানান মো. মাহবুব-উল হক। তিনি বলেন, তার কার্যালয়ে ১৫টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন চারজন। এছাড়া সাত কেন্দ্রের কাজ করা হচ্ছে চারজনকে দিয়ে। ফার্মে ২০ জন থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন কেবল একজন। অবসর ও মৃত্যু জনিত কারণে এসব পদ শূন্য হলেও সেগুলো এখনো পূর্ণ করা হয়নি। কর্তৃপক্ষের কাছে লোকবল সংকটের নিরসন হলেএ সমস্যার সমাধান হলে রেশম চাষের তদারকি আরো ভালোভাবে করা সম্ভব হবে।