নাটোরে লালন একাডেমির জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব, বন্ধ সংগীতচর্চা
নাটোরে প্রতিষ্ঠিত লালন একাডেমির জমির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বে স্থবির হয়ে পড়েছে একাডেমির কার্যক্রম। স্থানীয় অধিবাসী ও শিল্পীদের দাবী, সমস্যার সমাধান না হওয়ায় বন্ধ রয়েছে সংগীতচর্চাও। স্থানীয়দের অভিযোগ, সন্ধ্যায় একাডেমি চত্বর পরিণত হয় মাদকসেবীদের আড্ডাস্থলে। বেকায়দায় পড়েছেন শিল্পীরা।
জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার বজরাপুর এলাকার আব্দুল করিমের ছেলে কামরুল ইসলাম ওই জমির মালিক দাবি করে বলেন, জমিটি মূলত তার নানা হজরত আলী সরকারের। তার একমাত্র মামা শরিফ ছাড়াও মা সুরাইয়া, খালা সুফিয়া, ছইজান ও সামিয়ারা তার নানার সন্তান। নানা মারা যাওয়ার আগে কিছু জমি মামাকে রেজিস্ট্রি করে দেন। নানা মারা যাওয়ার পর মামা,মা ও খালাদের মধ্যে এজমালি সম্পত্তি স্থানীয় ও পারিবারিকভাবে আপস বণ্টন হয়। এতে বর্তমানে লালন একাডেমির জায়গাটি তার মা পান। এরপর ওই জমি তার মা তাকে রেজিস্ট্রি করে দেন। এরপর জমির খাজনা খারিজ করে ভোগদখলও করছিলেন তিনি।
অপরদিকে তার মামা শরিফ তার সমস্ত সম্পত্তি স্ত্রী ও ছেলেকে রেজিস্ট্রি করে দেন। এরপর তার নামে রেজিস্ট্রি ও খারিজ হওয়া ওই ২৬ শতক জমি লালন একাডেমিকে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে তাকে বেদখল করা হয়। তিনি ওই জমির দখল পেতে এরই মধ্যে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছেন।
লালন একাডেমির জমিদাতা শরিফ জানান, তার বাবা বেঁচে থাকতে তাকে ১০-১২ বিঘা এবং তার দুই ছেলেকে ১০ বিঘা জায়গা রেজিস্ট্রি করে দেন। বাবার মৃত্যুর পর এজমালি জমি পারিবারিক আপস মিমাংসায় মায়ের অংশ দেওয়া ছাড়াও সব বোনকে ৪ বিঘা করে আর তাকে হিসেব মতো ৮ বিঘা জায়গা দেওয়া হয়েছে।
এরমধ্যে ওই ২৬ শতক জমি তার অংশে রয়েছে দাবি করে তিনি আরও বলেন, সাবেক ডিসি শাহিনা খাতুনের আহ্বানে তিনি ওই জমি ২০০৯ সালে লালন একাডেমির নামে ওয়াকফ করে দেন। এরপর সেখানে কাজ শুরু হলে তার বোনেরা বাধা দেন৷ বিষয়টি জানতে পেরে ২০১৭ সালে ডিসি শাহিনা খাতুন তার তিন বোন ও কামরুলের বাবা করিমকে ডেকে তাদের কাছ থেকে লিখিত নেন। তাতে তারা ওই জমির দাবি ত্যাগ করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে শরীফ জানান, তার বাবার জমি বণ্টননামার জন্য তিনি আদালতে মামলা করেছেন। মামলাটি চলমান।
লালন একাডেমির কার্যকরী কমিটির সাবেক সভাপতি আব্দুল লতিফ খোকা জানান, ওই বিবাদমান গ্রুপ কাউকে মানতে চায় না। তারা সবাইকে অবমাননা করে। মাঝে মাঝে এসে তারা হট্টগোল করে। এসব কারণে তিনিসহ লালনশিল্পীরা ওই একাডেমিতে যাওয়া বন্ধ করেছেন। এতে শিল্পীদের সংগীতচর্চা বন্ধ রয়েছে; যা সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। এ ক্ষতি পোষানোর পাশাপাশি সংগীতচর্চায় একাডেমিতে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ চান তিনি।
লালন একাডেমির কার্যকরী কমিটির সাধারণ সম্পাদক নয়ন হালদার বলেন, এখন প্রতি সন্ধ্যায় লালন একাডেমি সংগীতচর্চার বদলে মাদকসেবীদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে। এতে বেকায়দায় পড়েছেন লালন শিল্পীরা।
এক প্রশ্নের জবাবে নয়ন বলেন, সংগীতচর্চা বা কোনো অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিলে ওই দুই পক্ষ এসে সমস্যার সৃষ্টি করে। দুই পক্ষের লোকজন ওই জমির মালিকানা দাবি করে কমিটির নেতৃত্ব চায়। এমন অবস্থায় সংগীত শিল্পীরা উভয়পক্ষের বিবাদ-সংঘরর্ষের আশঙ্কায় একাডেমিতে যাওয়া বন্ধ করেছেন।
অবিলম্বে এ সমস্যার সমাধান প্রত্যাশা করেন তিনি। লালন একাডেমির জন্য নিষ্কন্টক জায়গা প্রয়োজন। এব্যাপারে তিনি জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবার আশু পদক্ষেপ কামনা করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, কামরুল ইসলামের লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করতে সদর ইউএনওকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
লালন সংগীত ও ফকির লালনকে নিয়ে গবেষণা, সংগীতচর্চা আর লালন ফকিরের জীবনাদর্শকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষে নাটোরে প্রতিষ্ঠা করা হয় জেলা লালন একাডেমি। সাবেক জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুনের উদ্যোগে সদর উপজেলার কাফুরিয়া ইউনিয়নের জালালাবাদ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় ওই একাডেমি। এরপর থেকে লালনের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে জাঁকজমক অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে একদিন করা হতো সংগীতচর্চা। ওই অনুষ্ঠানে জেলার বাইরে থেকেও আসতেন শিল্পীরা। জেলা প্রশাসনের সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত লালন একাডেমি পরিচালনায় উপজেলা পর্যায়েও গঠন করা হয় কমিটি। একাডেমিতে দলে দলে যোগ হতে থাকেন লালনশিল্পী আর সাধুরা। সাবেক ওই ডিসি নাটোরে থাকাকালে তিনি ছিলেন লালন একাডেমির পরিচালনা পর্ষদের প্রধান উপদেষ্টা।
এসএন