'লালনের আদর্শে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে'
সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে লালনের আর্দশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানান কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ।
তিনি বলেন, 'বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের কোনো ধর্ম ও জাত ছিল না৷ লালনের একটি মাত্র পরিচয় ছিল সেটি হচ্ছে মানবতা৷ তিনিই একমাত্র বাউল সাধক যিনি সকল ধর্মের সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে সদা সত্য পথে চলতে মানুষকে মানবতাবাদীর পথে ডাক দিয়েছিলেন৷ তিনি অহিংস মানবতার ব্রত নিয়ে মানুষের কল্যাণে অসংখ্য গান সৃষ্টি করে গেছেন৷ তার এই অমর সৃষ্টি সংগীত কোনো ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না৷ সকল ধর্মের ঊর্ধ্বে থেকে সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ করতে মরমী এই সাধক মানব মুক্তির জন্য সৃষ্টি করেছিলেন ফকিরি মতবাদ৷ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু লালনের আর্দশে অনুপ্রাণিত হয়ে সেদিন সম্প্রীতির বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তুলতে বলেছিলেন ধর্ম যার যার, উৎসব সবার৷ আজকের যুগে তার এই আহ্বান একেবারেই বাঙালি জাতির জন্য সমকালীন৷ তাই আসুন সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে লালনের আর্দশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ে তুলি৷'
বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) রাতে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে লালন একাডেমির আয়োজনে বাউল সম্রাট ফকির লালনের তিন দিনব্যাপী স্মরণোৎসব অনুষ্ঠানের সমাপনী দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন৷
তিনি বলেন, 'সক্রেটিসসহ বিশ্বের প্রখ্যাত সব দার্শনিকদের মতবাদের সঙ্গে লালনের গানের ভাবাদর্শের মিল রয়েছে অনেকখানি৷ সবাই তাদের চিন্তা দিয়ে মানুষের প্রতি মানুষের ভালাবাসার কথা বলেছেন৷ বলেছেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা৷'
মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, 'আমাদের সমাজে এক শ্রেণির লোক ধর্মকে হাতিয়ার বানাতে চায়৷ তারা ধর্ম ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িকতার বিষ সমাজে ছড়িয়ে দিয়ে কীভাবে এদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে কিংবা চালাচ্ছে বাংলার মানুষ তা দেখে হতবাক হয়েছে৷ ধর্মের নামে সাধারণ নিরীহ মানুষের উপর নৃশংস বর্বরতা ও হানাহানি করে জাতিকে বিভক্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে৷ যা কোনো সভ্য সমাজের কাম্য নয়৷ এভাবে বর্বরতা চালিয়ে বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করা যাবে না৷ লালনের আর্দশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার শিক্ষায় দীক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে৷'
বক্তব্যের মাঝে তিনি নিজেই বাউল সম্রাট ফকির লালনের অমর বাণী 'খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়' গানটি গেয়ে দর্শক-শ্রোতাদের শোনান৷
প্রধান অতিথি সাংসদ হানিফ আরও বলেন, 'বাউল সম্রাট ফকির লালনের সৃষ্টি দেশের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই৷ বিশ্বে তাকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে৷ অথচ আমাদের এখানে লালনের ভাবাদর্শ নিয়ে তেমন একটা চর্চা দেখা যায় না৷ ফকির লালনের চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে সমাজের সব প্রকার হানাহানি-কাটাকাটি দূর করা সম্ভব৷'
তিনি বলেন, 'এই মরমী সাধকের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও তিনি ছিলেন আধুনিক সমাজ বিন্যাসে স্ব-শিক্ষিত৷ তার জ্ঞানের ভাণ্ডার আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি ছিল৷ আসুন দেশ ও জাতির কল্যাণে সকলে এক হয়ে লালনের অমর বাণী বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাই৷'
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়া-৪ (খোকসা-কুমারখালি) আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ, কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য আ কা ম সরওয়ার জাহান বাদশা, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খাইরুল আলম, কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব সদর উদ্দিন খান ও সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী, কুষ্টিয়া জজকোর্টের পিপি অ্যাডভোকেট অনুপ কুমার নন্দী, লালন একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাইজাল আলী খান, চাপড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক মঞ্জু, কুষ্টিয়া প্রেস ক্লাব-কেপিসির সভাপতি রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব প্রমুখ৷
প্রধান আলোচক হিসেবে লালনের জীবন, দর্শন ও সৃষ্টি গানের মর্মকথা নিয়ে আলোচনা করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শেখ আব্দুস সালাম৷ আলোচক হিসেবে তার ভাবাদর্শ নিয়ে আলোচনা করেন লালন মাজারের খাদেম মোহাম্মদ আলী৷ শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শারমিন আখতার ও কুমারখালি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিতান কুমার মন্ডল৷ স্বাগত বক্তব্য রাখেন লালন একাডেমির এডহক কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট শহিদুল ইসলাম৷
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, এবারের স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠানে আসা দেশ-বিদেশের লাখ ভক্ত অনুরাগী ও সাধু-গুরুদের চরণ ধুলায় সিক্ত বাউল সম্রাটের ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি৷ তার মতাদর্শের ধর্ম আর জাতি ভেদাভেদ ভুলে মানুষের কল্যাণে মানুষ নিবেদিত থাক চিরকাল। সভ্যতার এই যুগে মানুষ হিংসা বিদ্বেষ ভুলে তার জাতহীন মানব দর্শনের 'মনের গরল যাবে যখন, সুধাময় সব দেখবি তখন' এই স্লোগানকে বাস্তবায়নে সদা সত্য ও সঠিক পথে চলে দেশ ও জাতির উন্নয়নে নিজেদের নিয়োজিত রাখতে হবে৷ মরমী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালনের অহিংস মানবতা ও ফকিরি মতবাদের জাতহীন মানব দর্শন ও সংগীত দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বাঙ্গনে নিজের মহিমায় জায়গা করে নিলেও বাংলা ভাষা ব্যতিত অন্য কোনো ভাষায় প্রকাশ, প্রচার ও প্রসার ঘটেনি তেমন একটা৷ এ ব্যাপারে আরও উদ্যোগী হতে হবে৷ মানবতার মুক্তি ও ভক্তির পথকে প্রতিষ্ঠা করতেই ফকির লালন হাজারো ভাবধারার গান সৃষ্টি করছেন৷ কিন্তু তা বিশ্ববাসীকে নাড়া দিতে পারেনি যথার্থ একাডেমিক প্রচার আর প্রকাশনার অভাবে৷ লালন অতি কঠিন কথাগুলো খুব সহজ করে তার গানে বলে গেছেন৷ তার অমর সৃষ্টি সংগীত গতানুগতিকভাবে প্রচার ও প্রকাশ হলে চলবে না৷ বিশ্বের বিশিষ্ট গবেষকেরা লালনের সৃষ্টি আরও নতুন নতুন তথ্য জানতে চায়৷
লালন একাডেমির সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. সাইদুল ইসলাম তিন দিনের স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠান সফল, স্বার্থক ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হওয়ায় আইন-শৃংখলায় নিয়োজিত পুলিশ, র্যাব, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ, দেশ-বিদেশ থেকে আসা লালনের অগুণিত ভক্ত অনুরাগী ও সাধু-গুরু, সাংবাদিকসহ এলাকার সুধীজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ও আগামী তিরোধান দিবসের অগ্রীম আমন্ত্রণ ও ধন্যবাদ জানান৷
আলোচনা শেষে দ্বিতীয় পর্বে লালন মঞ্চে বিভিন্ন শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে লালন সংগীত পরিবেশিত হয়৷ এতে সংগীত পরিবেশন করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাউল শিল্পী সমীর বাউল, সুফিয়া কাঙ্গালিনীসহ দেশের খ্যাতনামা শিল্পীরা এবং লালন একাডেমির স্থানীয় শিল্পীরা৷
তিন দিনব্যাপী স্মরণোৎসব দিবসের অনুষ্ঠানমালার উপস্থাপনা করেন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের এনডিসি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সবুজ হাসান, মুনিরা সুলতানা, সিফাতুন নাহার, কাজী শারমিন আখতার, ফারহানা ইয়াসমিন ও কনক চৌধুরী৷
টিটি/