পাঁচ টাকার নোটে অঙ্কিত নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ
ঐতিহ্যবাহী কুসুম্বা মসজিদ। অনন্য স্থাপত্যশৈলীর দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদটি শুধু নওগাঁয় নয়, বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদগুলোর অন্যতম। স্থানীয়দের কাছে এটি কালাপাহাড় নামেও পরিচিত।
প্রতিনিয়ত দূর-দূরান্ত থেকে প্রচুর পর্যটক আসেন পাঁচ টাকার নোটে অঙ্কিত নওগাঁর ঐতিহ্য কুসুম্বা মসজিদ দেখতে।
জানা যায়, নওগাঁ মান্দা উপজেলার কুসুম্বা গ্রামে দিঘির পশ্চিম পাড়ে পাথরের তৈরি ধূসর বর্ণের এ মসজিদটি অবস্থিত। প্রবেশমুখে বসানো ফলকে মসজিদের নির্মাণকাল লেখা রয়েছে হিজরি ৯৬৬ সাল (১৫৫৮-১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দ)। সুলতান গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহের রাজত্বকালে সুলতান সোলায়মান মসজিদটি নির্মাণ করেন।
১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদের তিনটি গম্বুজ নষ্ট হয়ে যায়। পরে সেগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংস্কার করে। পরবর্তীকালে ২০১৭ সালে মসজিদের চতুর্দিকে ও পূর্বপার্শ্বে অবস্থিত দিঘির পাড়ে ফুলের বাগান নির্মাণ ও আলোকসজ্জার কাজ করা হয়।
কালো পাথরে নির্মিত এ মসজিদটি প্রায় ৪৬২ বছরের আগের। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ ফুট ছয় ইঞ্চি ও প্রস্থ প্রায় ৪৪ ফুট ছয় ইঞ্চি। দুই সারিতে ছয়টি গোলাকার গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের গায়ে রয়েছে মনোরম লতাপাতার নকশা।
মসজিদে মাঝের প্রবেশপথের ওপর ফলকে আরবি ভাষায় একটি লিপি লেখা রয়েছে। এর পূর্ব প্রান্তে তিনটি ও উত্তর-দক্ষিণে একটি প্রবেশপথ রয়েছে।
মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণের স্তম্ভের ওপর একটি উঁচু আসন রয়েছে। ধারণা করা হয়, এ আসনে বসেই তৎকালীন কাজী-বিচারকরা এলাকার বিচারকার্য করতেন।
মসজিদে মোট মিহরাব রয়েছে তিনটি। যার সবগুলো কালো পাথরের তৈরি। মিহরাবে আঙ্গুরগুচ্ছ ও লতা-পাতার নকশা খোদিত করা রয়েছে।
মসজিদের কেন্দ্রীয় মিহরাবটি পশ্চিম দিকের দেয়ালের থেকে আলাদা। পশ্চিম দেয়ালের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ও মাঝের প্রবেশপথ বরাবর দুটো মিহরাব রয়েছে। যা মেঝের সমান্তরাল। উত্তর-পশ্চিম কোণের মিহরাবটি শুধু একটি উঁচু বেদীর উপর বসানো।
এ ছাড়া মসজিদে নারীদের নামাজ পড়ার আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে।
মসজিদের সামনে রয়েছে বিশাল আকৃতির দিঘি। দিঘির আয়তন প্রায় ৭৭ বিঘা। এর দৈর্ঘ্য এক হাজার ২৫০ ফুট ও প্রস্থ ৯০০ ফুট। দিঘিটি সুগভীর ও এর জলরাশি স্বচ্ছ।
কথিত আছে, ‘দিঘির তলদেশে পারদ মিশ্রিত থাকায় পানিতে কচুরিপানা বা অন্য কোনো আগাছা জন্মে না’।
এ দিঘিতে নামার জন্য দুটি দৃষ্টিনন্দন সিড়ি রয়েছে। এর শীতল পানিতে ওজু করেন মুসল্লিরা। আর দর্শনার্থীরা হাতমুখ ধুয়ে দূর করেন ক্লান্তি। এ ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারা এখানে গোসলও করে থাকেন।
এদিকে মসজিদে যাওয়ার প্রায় ৫০০ ফুট আগে রাস্তার ডানপাশে বাক্স আকৃতির একটি কালো পাথর আছে।
কথিত আছে, ‘জনৈক কৃষক হালচাষের সময় জমিতে এ পাথরটি খুঁজে পান। এসময় নাঙ্গলের ফলার আঘাতে কিছুটা ভেঙেও যায়। পাথরটি জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়। উদ্ধারকৃত পাথরের গায়ে তোগড়া হরফে আরবিতে লেখা রয়েছে, আল মালিকু মা হুমম মোকাররামা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আশরাফ আল হোসেন। অর্থাৎ শাসক, পরাক্রমশালী ও সম্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হোসেনের ছেলে আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ। এ থেকে বোঝা যায় পাথরখণ্ডটি হুসেন শাহের স্মৃতিবিজড়িত।'
এ ছাড়া কুসুম্বা মসজিদের পশ্চিম পাশে প্রায় ২০০ মিটার দূরে অবস্থিত সোনাদীঘি। অনেক দর্শনার্থী এ দিঘির বিষয়টি জানেন না। ফলে তারা সোনাদীঘি না দেখেই মসজিদ ও দিঘি দেখেই ফিরে যান।
কথিত আছে, ‘সুলতান আলাউদ্দীন হোসাইন শাহের সোনা নামের এক আদরের মেয়ে ছিলেন। অকালে তার মৃত্যু হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন সুলতান। সে মেয়ের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতেই সোনাদীঘি খনন করা হয়।'
স্থানীয় সম্রাট হোসেন জানান, এটি জেলার অন্যতম ঐতিহাসিক পর্যটনকেন্দ্র। দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন। মসজিদটিকে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। দর্শনার্থীরা মসজিদ ও দিঘি দেখার পর বিনোদনের আর তেমন কোনো জায়গা পান না। পার্ক থাকলে এ সমস্যা দূর হতো।
মান্দা কুসুম্বা মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম জানান, প্রতিটি জুম্মাবারে প্রায় ১০-১২ হাজারের মতো মানুষ আসে এখানে। মসজিদের চারপাশে ও দিঘিতে নামার সিড়িতে টাইলস বসিয়ে ও লাইটিং করে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কমিটি থেকে মসজিদের পাশে ওজুখানা, নারী-পুরুষদের আলাদা শৌচাগারসহ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করার চেষ্টা করেছিলাম। সেটা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাজ হওয়ায় আমাদের কাজটি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। দর্শনার্থীরা আসার পর তারা একটু বিশ্রাম নিবে সে জায়গারও সঙ্কট রয়েছে।
মসজিদে ঘুরতে আসা সুমন হোসেন এক পর্যটক বলেন, এখানে আসার ইচ্ছেটা অনেক দিনের ছিল। কারণ প্রতিদিনই পাঁচ টাকার নোটের উপর এ মসজিদের ছবি দেখি। তবে এখানে এসে মনে হলো বিপুল সম্ভবনা থাকার পরও প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবে কুসুম্বা মসজিদ আকর্ষণীয় স্পট হিসেবে গড়ে উঠছে না।
যেভাবে যাবেন-
ঢাকা থেকে নওগাঁ নিয়মিত বাস চলাচল করে। যেকোনো বাসে যেতে পারেন। আর নওগাঁ শহর থেকে কুসুম্বা মসজিদ পর্যন্ত বাসযোগে যেতে সময় লাগবে ৪০ মিনিটের মতো। থাকার জন্য নওগাঁতে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো রয়েছে। এ ছাড়া বেশকিছু ভালো মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। যাবার পথে ফেরিঘাট বাজারে বেশকিছু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ও রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে পারবেন।
টিটি/