জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ১৬৬টি সংস্কার সুপারিশে ত্রিমুখী অবস্থানে রয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। কমিশনের পাঠানো সুপারিশমালায় তিনটি দল কিছু বিষয়ে একমত হলেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইস্যুতে রয়েছে মতপার্থক্য। বিশেষ করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি, নির্বাচনকালীন সরকার এবং সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে রয়েছে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।
বিএনপি স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ২০২৪ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে এক কাতারে দেখার বিষয়ে তারা একমত নয়। একইসঙ্গে রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবেও তারা রাজি নয়। তবে বিচার বিভাগের অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাবে দলটি একমত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো এবং নির্বাচনি সীমানা নির্ধারণে অধ্যাদেশের মাধ্যমে পরিবর্তনের পক্ষে মত দিয়েছে দলটি। দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত ২০টি প্রস্তাবের মধ্যে ১১টিতে সরাসরি একমত, কিছুতে নীতিগত মতামত এবং একটি বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়েছে বিএনপি। প্রশাসন সংস্কারের ক্ষেত্রেও ২৬টি প্রস্তাবের অর্ধেক নিয়ে ভিন্নমত বা মন্তব্য দিয়েছে দলটি।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী সংবিধানের মূলনীতিতে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে। দলটি সংখ্যানুপাতিক (PR) পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে এবং নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা, রিটার্নিং ও প্রিসাইডিং অফিসারদের নিরপেক্ষতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ধারণা এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের বিষয়ে তারা একমত হলেও পুরোপুরি সমর্থন দেয়নি। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বাজেট ও আস্থাভোট বিষয়ে ব্যতিক্রমী মত দিয়েছে দলটি। জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চায় না।
এদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মোট ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে ১১৩টিতে একমত, ২৯টিতে আংশিক একমত এবং ২২টিতে ভিন্নমত জানিয়েছে। দলটি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে গণপরিষদ নির্বাচন হিসেবে আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে। তারা চায় প্রার্থী মনোনয়নে ১০ শতাংশ তরুণ-তরুণী অন্তর্ভুক্তি এবং সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর নির্ধারণ। সংসদ সদস্য হওয়ার বয়সসীমা ২৩ বছর করা, বিরোধীদল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ এবং সংসদে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে মত প্রকাশের সুযোগ রাখার প্রস্তাব দিয়েছে এনসিপি।
তারা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে মত দিলেও উচ্চকক্ষের প্রার্থীদের নির্বাচন পূর্ব ঘোষণা চায়। এনসিপি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং বলেছে, দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়া উচিত। নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ৭০-৭৫ দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে এবং এনসিসিকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। এছাড়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে এনসিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের সুযোগ রাখা, বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা ও নিজস্ব সচিবালয় প্রতিষ্ঠার দাবিও জানিয়েছে তারা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় দলগুলো অংশ নিলেও তাদের অবস্থানভেদে রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠনের পথে চ্যালেঞ্জ থেকেই যাচ্ছে।