দেশের বৃহত্তম স্থল বন্দর বেনাপোল দিয়ে আমদানি রপ্তানি কমলেও বেড়েছে রাজস্ব আদায়ের হার আর এই কাজটি সম্পন্ন সম্ভব হয়েছে বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সময় উপযোগী পদক্ষেপের কারণে। সে কারণে গত ৯ মাসে বিগত অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৩৬৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এরপর থেকে দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে আমদানি ও রফতানি কমলেও বেড়েছে রাজস্ব আদায়।
কাস্টমস অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বেনাপোলে যোগদানের পর কাস্টমস কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বন্দরের প্রত্যেকটি শেডে নিজে যেতেন। এর ফলে ওই মাসেই ১৭ নম্বর শেড পরিদর্শনকালে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আনা কোটি টাকার পণ্য আটক করেন। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি তার নেতৃত্বে ট্রাকসহ অর্ধ কোটি টাকার অবৈধ পণ্য আটক করা হয়। ওই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ’র লাইসেন্স বাতিলসহ মোটা অঙ্কের অর্থ জরিমানা আদায় করেন।
তার কারণে আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট সক্রিয় হয়ে ওঠে। তার সময়কালে এই চেকপোস্টে ১২ হাজার ৩৪২টি পণ্যের (ডিএম) চালান আটক করা হয়। যা সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিমত, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর দু’দেশের সম্পর্কের টানাপড়েনের প্রভাব পড়ে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলে।
কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই থেকে মার্চ ) ভারতে প্রায় ২৮ লাখ ৪০ হাজার ৯৯ টন পণ্য রফতানি হয়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে প্রায় ২৯ লাখ ৪৩ হাজার ৭১ টন পণ্য রফতানি হয়েছিল। হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরের তুলনায় ১০ হাজার ২৭২ টন পণ্য কম রফতানি হয়েছে।
একই সময় ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম ৯ মাসে ভারত থেকে প্রায় ১২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৪৬ দশমিক ২৯ টন পণ্য আমদানি হয়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে প্রায় ১২ লাখ ৫২ হাজার ৭৬৭ দশমিক ২৯ টন পণ্য আমদানি হয়েছিল। গত অর্থবছরের তুলনায় একই সময়ে ১৯ হাজার ২০ দশমিক ৮২ টন কম পণ্য আমদানি হয়েছে।
সূত্র জানায়, পণ্য আমদানি কিছুটা কমলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৩৬৬ দশমিক ১৫ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। বেনাপোল কাস্টম হাউসে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৬ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। সেই আলোকে অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৪৩২ দশমিক ৩ কোটি টাকা। সেখানে আদায় হয়েছে ৫ হাজার ৭৯৭ দশমিক ৭৬ কোটি টাকা।
যার মধ্যে জুলাই মাসে ৪১৩ দশমিক ২২ কোটি টাকা, আগস্ট মাসে ৪০১ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা সেপ্টেম্বর মাসে ৪৮৯ দশমিক ১১ কোটি টাকা, অক্টোবর মাসে ৫২৪ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা, নভেম্বর মাসে ৬১৪ দশমিক ৭১, ডিসেম্বর মাসে ৭৭৮ দশমিক ৯৫ কোটি টাকা, জানুয়ারি মাসে ৬২১ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ৮১৮ দশমিক ৫ কোটি টাকা এবং মার্চ মাসে ৭৭০ দশমিক ১১ কোটি রাজস্ব আদায় হয়েছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মহসিন মিলন বলেন, ‘দেশে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পরে দু’দেশের রাজনৈতিক টানাপড়েন থাকায় ভারত থেকে আমদানি কিছুটা কমলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় বেশিরভাগ আমদানিকারক বেনাপোল বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী। বেনাপোল কাস্টমস কমিশনারের যেকোনো বিষয়ে তড়িৎ সিদ্ধান্তের কারণে কাস্টমসের বাড়তি রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ।তবে বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ রাজস্ব ফাঁকি রোধে কড়াকড়ি আরোপ করায় অসাধু ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলহাজ্ব শামছুর রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বর্তমান কাস্টমস কমিশনার বাণিজ্য সম্প্রসারণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। গত তিন মাস বেনাপোল বন্দরে কার্গো ভেহিকেল টার্মিনাল চালু ও বসানো হয় স্ক্যানিং মেশিন। দ্রুত পণ্য খালাস ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উদ্যোগে বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ রাজস্ব ফাঁকি রোধ ও বাণিজ্য সহজীকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এতে বর্তমানে বাণিজ্যে অনেকটা গতি ফিরেছে, কমেছে হয়রানি। যা সামনের দিনে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আমদানি-রফতানি বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে।
তিনি আরও জানান, বিগত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের শেষ সময়ে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাওয়া যাচ্ছিল না। এ কারণে সে সময় পর্যাপ্ত এলসি খোলা সম্ভব ছিল না। কিন্তু বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ধীরে ধীরে ডলার সংকট কেটে গেছে। এখন আর আমদানিকারকদের এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে না।
বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, বৈধ আমদানি-রফতানি বাণিজ্য সহজীকরণে সময়োপযোগী প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এতে বেনাপোলে সার্বিক আমদানি কমলেও রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৩৬৬ দশমিক ১৫ কোটি টাকা বেশি আদায় হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ শতাংশের মতো।
এ বন্দরে আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে শিল্প কারখানার কাঁচামাল, তৈরি পোশাক, গার্মেন্টস, শিশু খাদ্য, মাছ, কেমিকেলসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। আর রপ্তানি পণ্যের মধ্যে পাট, পাটের তৈরি পণ্য, গার্মেন্টস, তৈরি পোশাক, কেমিকেল, টিস্যু পেপার, মেলামাইন ও মাছ উল্লেখযোগ্য।