খুলনা-মোংলা রেললাইন
এক যুগেও শেষ হয়নি, ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণ
চতুর্থ দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে খুলনা-মোংলা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের। তৃতীয় দফায় বাড়ানো মেয়াদ অনুযায়ী চলতি বছর ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু তা শেষ না হওয়ায় আবারও ছয় মাস মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটির নির্মাণকাজ ১২ বছরেও শেষ হয়নি। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় বরাদ্দও বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।
প্রকল্প অফিসের তথ্য অনুযায়ী, খুলনার মোংলা বন্দরের সঙ্গে সারাদেশের রেলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ২০১০ সালে খুলনা-মোংলা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। এর ছয় বছর পর ২০১৬ সালে প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয়। দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলার সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর পণ্য পরিবহন সহজতর করতে ভারতীয় ঋণের টাকায় এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ-এর নির্বাহী কমিটি) প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। এর প্রায় ৬ বছর পরে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর মাঠপর্যায়ে সম্ভাব্যতা যাচাই, নকশাসহ আনুষঙ্গিক কাজ শুরু হয়।
২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি জেলা প্রশাসন সর্বশেষ ভূমি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে। এরপর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত। এরপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর এবং তারপর ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। এরপর আরও এক দফা সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে এর কাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এই সময়েও কাজ শেষ না হওয়ায় আবারও সময় বৃদ্ধির জন্য আবেদন করা হয়েছে। বারে বারে প্রকল্পের ডিজাইন পরিবর্তন হওয়ায় এর মেয়াদ ও প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা; বর্তমানে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বাড়তি ব্যয়ের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি।
প্রাপ্ত নথিপত্র থেকে জানা যায়, খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পটির কাজ ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ তিন থেকে চার মাসের মধ্যে শেষ করা যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা প্রকাশ করেছেন। এরই মধ্যে প্রকল্পটির মেয়াদ আরও ছয় মাস বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেই হিসাবে প্রকল্পটি আগামী জুন মাসের মধ্যে শেষ হবে এবং ওই সময়ের মধ্যেই রেল চলাচলের জন্য রেলপথটি উন্মুক্ত করার কথা রয়েছে।
প্রকল্প অফিসের তথ্য, সরেজমিন পরিদর্শন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রকল্পের প্রধান কাজগুলো হলো, ৭৭৬ দশমিক ৬৭ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা, খুলনা থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার মেইন লাইন নির্মাণ, ২১ দশমিক ১১ কিলোমিটার লুপ লাইন নির্মাণ, আটটি রেলওয়ে স্টেশন তৈরি করা। এ ছাড়া ৩১টি মেজর ও মাইনর ব্রিজ নির্মাণ করা, ১১২টি কালভার্ট, রূপসা নদীর উপর ৭১৬ দশমিক ৮০ মিটার সেতু নির্মাণ করা, রূপসা সেতুর দুই প্রান্তে ভায়াডাক্ট (উড়াল পথ) নির্মাণ, ২০০ মিটার আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা এবং ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেম নির্মাণ করা।
স্বাভাবিকভাবে এই রেললাইন প্রকল্পে কয়েকটি ধাপ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, রেলপথ তৈরি, ওয়ে (লাইন) স্থাপন করা, সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা, গুরুত্বপূর্ণ সড়কে আন্ডরপাস নির্মাণ করা, কালভার্ট, ব্রিজ, স্টেশন ভবন, বিভিন্ন সড়কের সংযোগ মুখে নিরাপত্তা কক্ষ তৈরি এবং রূপসা নদীর উপর রেলসেতু নির্মাণ করা। এসব কাজের মধ্যে রেললাইন নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ৯০ ভাগ। মূল রেললাইন ৬৫ কিলোমিটার; এ ছাড়া রয়েছে ২৪ কিলোমিটার লুবস অ্যান্ড ইয়ার্ড লাইন। আটটি স্টেশন ভবনের মধ্যে পাঁচটির কাজ প্রায় শেষ হলেও বাকি ৩টির কাজ গড়ে ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে। রূপসা নদীর উপরের সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তবে এতে এখনো রেললাইন বসানো হয়নি। রেললাইনের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রিক সিগনাল স্থাপন করা। সিগনাল স্থাপনের কাজ এখনো শেষ হয়নি।
প্রকল্প কর্মকর্তারা দাবি করেন, শুরু থেকেই প্রকল্পটি নানা বাধার মুখে পড়ে। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটির ঠিকাদার নিয়োগ দিতেই দুই বছর সময় পেরিয়ে যায়। তারপর দফায় দফায় এর নকশায় পরিবর্তন হয়েছে, সময় বাড়ানো হয়েছে, ব্যয়ও বেড়েছে যথারীতি। সার্বিকভাবে প্রকল্পটির কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ্জামান জানান, আমাদের দেশে উন্নয়নমূলক কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হওয়ার নজির খুবই কম। প্রকল্প গ্রহণের আগে সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করে দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেই অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় ব্যয়ও বাড়ানোর উদাহরণ খুলনা-মোংলা রেললাইন স্থাপন প্রকল্প। এটির ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকায় শেষ করার কথা থাকলেও সেই ব্যয় এখন ৪ হাজার ২৬০ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই প্রকল্পের পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান জানান, কয়েক দফা নকশা পরিবর্তন, নতুন নতুন বিষয় সংযুক্ত হওয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যায়নি। সর্বশেষ বর্ধিত মেয়াদ অনুযায়ী চলতি মাসেই শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এখনো কিছু কাজ বাকি রয়েছে। তাই ৬ মাস মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আশা করছি এই সমযের মধ্যেই পরিপূর্ণ নির্মাণ কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।
খুলনা-৫ (ফুলতলা- ডুমুরিয়া) আসনের সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, এ রেললাইন চালু হলে, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগের মাধ্যমে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি খরচ সাশ্রয় হবে। নির্দিষ্ট সময়ে নতুন এই লাইনের কাজ শেষ না হওয়া দুঃখজনক। আমি মনে করি প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঠিক তদারকি না থাকায় সরকারের নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় না।
এসএন