বিশ্ব বন দিবস
দিন দিন কমছে শেরপুরের বনাঞ্চল
শেরপুরের নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তজুড়ে গারো পাহাড় অবস্থিত। এই বিশাল বনভূমি প্রায় পুরোটাই বন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। এই তিন উপজেলার তিন রেঞ্জের আওতায় প্রায় ২০ হাজার একর বনভূমি রয়েছে। এই বনভূমির মধ্যে দুই হাজার একর জমি এখন দখলদারদের হাতে। যার বর্তমান মৌজা অনুযায়ী বাজার মূল্য ১১৬ কোটি টাকার বেশি। পাহাড় কেটে তৈরি করছে চাষাবাদের জমি, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বাড়ি। আবার দীর্ঘদিন ধরে বসবাসের দোহাই দিয়ে জমি ছাড়ছেন না দখলদাররা। প্রতিনিয়ত দখলের উৎসব চলছে বনের জমি। এতে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে গারো পাহাড়।
বন বিভাগের তথ্য মতে, শেরপুর বন বিভাগের আওতায় রাংটিয়া রেঞ্জে ৮ হাজার ৮৮০ একর, মধুটিলা রেঞ্জে ৪ হাজার ২৩৫ একর ও বালিজুড়ি রেঞ্জে ৭ হাজার ৩০০ একর বনভূমি রয়েছে। এই তিন রেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাংটিয়া রেঞ্জে ১ হাজার ২০০ একর বনভূমি বেদখলে রয়েছে। যার বর্তমান মৌজাভিত্তিক বাজারমূল্য ৭৫ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৬২৭ টাকা। বালিজুড়ি রেঞ্জের আওতায় ৪৭০ একর, যার মূল্য ২০ কোটি ৫০ লাখ ৬২ হাজার ২৪৯ টাকা। মধুটিলা রেঞ্জের আওতায় ৬০২ একর বনভূমি বেদখলে রয়েছে। মৌজাভিত্তিক এর বাজারমূল্য ২২ কোটি ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৫৫ টাকা। গেল ৪/৫ মাসে বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের অভিযানে বালিজুড়ি রেঞ্জে ৪০ একর, রাংটিয়া রেঞ্জে ৭০ একর ও মধুটিলা রেঞ্জ থেকে ২৫ একর জমি দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে। এখনও দুই হাজার একরের বেশি জমি দখলদারদের হাতে রয়েছে।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, যারা বনের ভেতরে বেশি জমি অবৈধভাবে দখল করে আছে। তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ ও ব্যবস্থা নিতে গেলে প্রভাবশালী হওয়ায় উল্টো হামলার শিকার হচ্ছেন তারা। সীমান্তে অবৈধ দখলে থাকা বেশিরভাগ জমিই এখন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও নেতাদের ছত্রছায়ায় রয়েছে। যে কারণে উচ্ছেদ করতে গেলে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়।
সূত্র আরও জানায়, বনভূমি দেখভাল ও রক্ষায় যে পরিমাণে জনবল থাকা প্রয়োজন, সেই পরিমাণে জনবল নেই বন বিভাগে। জনবল সংকটে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান ব্যাহত হচ্ছে। ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার একাধিক রাজনৈতিক নেতাদের প্রত্যক্ষ মদদে এই সীমান্ত এলাকায় অবৈধভাবে বালু, পাথর উত্তোলনের চেষ্টা করেন কতিপয় ব্যবসায়ী। তাদের বন বিভাগের সর্বশক্তি দিয়ে বাধা প্রদানের চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্যদিকে দীর্ঘসময় দখলে থাকা স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, অন্যত্র আবাসনের ব্যবস্থা না করে দিলে তাদের পক্ষে বনের জায়গা ছাড়া কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়।
নালিতাবাড়ীর পানিহাটা গ্রামের বাসিন্দা ফকির মিয়া বলেন, ‘ভাই আমার বাড়ি এখানে না, আরেকটু সামনে। আমার কোনো জায়গা জমি নাই, আমি বনের একটুখানি জমির মধ্যে কোনো মতে থাকি। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের কেনো এসব বলেন। আমাদের যদি বন ছাড়তে বলেন, ছাইড়ি দিমু তাও আমারে জড়ায়েন না।’
ঝিনাইগাতীর রাংটিয়া এলাকায় বনের জমিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন জিতার আলী (১১৭)। তিনি বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের আগে থাইক্কা (থেকে) এইহানে (এখানে) আমরা থাহি (থাকি)। আমি থাহি, আমার পুলাপাইন থাহে, নাই-নাতিও থাহে এহানে (এখানে)। আঙগর (আমাদের) জায়গা জমি নাই, তাই বনের জায়গাতেই থাহি। বন থনে (থেকে) হরাই (সড়িয়ে) দিলেই আমরা কই যামু। আঙগর আরেক জায়গায় থাহার ব্যবস্থা হইলে, তাইলে আমরা যামু গা।’
গজনী এলাকার কৃষক হেকমত আলী বলেন, ‘আমি বাপের কাছ থেকে এই জায়গা পাইছি। আমার বউ-পুলাপান লইয়া আমি এহন এই জাগাতি থাহি। এই গ্রামেই চাষাবাদ কইরা খাই। আঙগোরে এইহান থেকে তুইলা দিলে আঙগোর থাহার-খাওয়ার ব্যবস্থা কইরা তুইলা দিলে আমরা যাইতে পারমু।’
বালিজুড়ি এলাকার খ্রিস্টানপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আছমত আলী বলেন, ‘মেলা দিন (অনেকদিন) ধরে এই বনের জমিতে থাহি (থাকি), এমনে আঙগর (আমাদের) কোনো জমি নাই। আমরা বনের মধ্যে থাহি, বনের মধ্যেই চাষবাস করি, আর এসব বেইচি (বিক্রি) কোনোমতে দিনগুলা কাডাইতাছি (পার করছি)। আঙগর কই থাকবার কন, অন্য জায়গা মিল করে দিলে আমরা যামু গা, না হলে আমরা বনের মধ্যেই থাকমু।’
প্রকৃতি ও পরিবেশ বাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মেরাজ উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিনিয়ত বনের জমি দখল হচ্ছে। এতে বন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এক সময় এই বনের সবুজের সমারোহ ছিল, এখন অনেকটাই কমে গেছে। এটা শুধু দখলদারদের কারণে হয়েছে। তারা বনের গাছগুলো কেটে বসতবাড়ি, চাষাবাদসহ নানা কাজে ব্যবহার করছে। তাই আমরা প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করি, যাতে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে দখলদারদের কবল থেকে বন রক্ষা করে। আর বন বিভাগের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে যেন বনের মধ্যে কোনো সবজি বাগান না করে সেখানকার বাসিন্দারা। পাশাপাশি জমি উদ্ধারে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ যেন করেন।’
ঝিনাইগাতী উপজেলা চেয়ারম্যান এসএমএ ওয়ারেজ নাঈম বলেন, সীমান্তের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এখানে বাসবাস করছেন। হুট করেইতো আর তাদের সড়ানো যাবে না। পর্যায়ক্রমে তাদের পুর্নবাসন করে সড়াতে হবে।’
শ্রীবরদী উপজেলা চেয়ারম্যান এডিএম শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ইতিমধ্যে বনের কিছু জায়গা উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি বনের ভেতরে যারা বিভিন্ন খামার, স্থাপনা নির্মাণ করছে বা করা আছে সেগুলো প্রশাসনের মাধ্যমে অভিযান করে ভাঙা হচ্ছে।’
শেরপুরের সহকারী বন সংরক্ষক আবু ইউসুফ বলেন, ‘যারা বনের ভেতরে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা, বিভিন্ন ধরনের খামার, বনের জমিতে অবৈধভাবে বাগান তৈরি করছেন তাদের প্রশাসনের সহায়তায় উচ্ছেদের কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছি। ইতিমধ্যে তিন রেঞ্জে অনেক জমি উদ্ধার করেছি। তবে যারা বনের ভেতরে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস করে আসছেন, তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে বন থেকে উচ্ছেদ করা হবে। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে বনের জায়গা বাড়তে থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দখলদারদের তালিকা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছি। উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জবরদখলকারী যেই হোক না কেন, আমরা আমাদের বন বিভাগের জমি অবশ্যই অবৈধ দখলমুক্ত করার চেষ্টা করব।’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, ‘জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স; এটা যেই হোক না কেনো। ইতিমধ্যে জেলার কয়েকটি জায়গায় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা দীর্ঘ সময় ধরে বনের ভেতরে বসবাস করে আসছেন, তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে উচ্ছেদ করা হবে। পাশাপাশি বন বিভাগের জমিগুলো যেন বেদখল না হয়, সেদিকেও আমরা কাজ করছি।
টিটি/