বন্দরে ভিড়ছে তেলের ট্যাংকার, বাজারে কমছে না অস্থিরতা
চট্টগ্রাম বন্দরে ভোজ্য তেল আমদানিতে হেরফের হয়নি। কিন্তু বাজারে বাড়ছে দাম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে ভোজ্য তেলের দামে সৃষ্ট উত্তাপ কমার কোনো লক্ষণ নেই। একদিন দাম কমলে আরেকদিন বাড়ে। এতে ক্রেতাদের নাভিশ্বাস অবস্থা।
বুধবার (১৬ মার্চ) ও বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে ভোজ্য তেলের দাম খুব বেশি কমেনি। খুচরা বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকা থেকে ১৮০ টাকা। আবার সরিষার তেল প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মজুদ করে রাখা ভোজ্য তেল জব্দ করেছে ভোক্তা অধিদপ্তরসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
ক্রেতারা মনে করছেন, সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে গুজব ছড়িয়েও দাম বাড়ানো হচ্ছে। বাজারে পর্যাপ্ত মজুদ আছে ভোজ্য তেল। দেশের পরিশোধিত ও অপরিশোধিত আকারে দুইভাবে ভোজ্য তেল আমদানি হয়। পরিশোধিত ভোজ্য তেল বোতলজাত করে সরাসরি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। অপরিশোধিত ভোজ্য তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিশোধনাগারে পরিশোধন করা হয়। এরপর মিল গেট থেকে খুচরা আর পাইকারি পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, নিয়মিতভাবে ভোজ্য তেল আমদানি হচ্ছে। এরই মধ্যে বন্দরে ২৯ হাজার মেট্রিক টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে দুটি জাহাজে করে। আরেকটি জাহাজ ভিড়বে শনিবার (১৯ মার্চ)। এই জাহাজে ৪৩ হাজার টন সয়াবিন তেল আছে। জাহাজটি ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের পথে রয়েছে।
বন্দর সূত্র জানায়, গত ১১ মার্চ ‘এমটি লুকাস’ নামে একটি অয়েল ট্যাংকার যোগে আমদানি হয়েছে ১২ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন। সেখানে টিকে গ্রুপের শবনম ভেজিটেবলের ৪ হাজার টন, সুপার অয়েল রিফাইনারির ৮ হাজার টন সয়াবিন তেল আছে। পরদিন ১২ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে ‘এমটি প্যাসিফিক রুবি’ নামে আরেকটি ট্যাংকার। এই ট্যাংকারে আছে ১৭ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল। এসব তেলের মধ্যে মেঘনা গ্রুপের মেঘনা এডিবল অয়েল রিফাইনারির আছে ৭ হাজার টন, সিটি এডিবল অয়েলের ১০ হাজার টন। ১৯ মার্চ আরেকটি জাহাজ অপরিশোধিত ভোজ্য তেল নিয়ে ভিড়বে চট্টগ্রাম বন্দরে। এই ট্যাংকারে ৪২ হাজার টন সয়াবিন তেল আছে।
এমটি লুকাস ট্যাংকারের শিপিং অ্যাজেন্ট মোহাম্মদী ট্রেডিং করপোরেশন। প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার (অপারেশনস) আরিফুর রহমান বৃহস্পতিবার ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ট্যাংকারটি এসেছে আর্জেন্টিনা থেকে। সাইপ্রাসের পতাকাবাহী জাহাজটি থেকে অপরিশোধিত ভোজ্য তেল খালাস শুরু করতে ৩ থেকে ৪ দিন লাগবে। মোট ২৮ দিন লেগেছে জাহাজটি আর্জেন্টিনার বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছতে। কাস্টমসের কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই ভোজ্য তেল খালাস শুরু হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সংশ্লিষ্টরা জানান, ভোজ্য তেলের জাহাজগুলোর ড্রাফট বেশি থাকে। বেশিরভাগ ট্যাংকারের ড্রাফট ১০ মিটারের বেশি। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভেড়ানো যায় ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ। বন্দর বহির্নোঙরে জাহাজ থেকে ছোট লাইটার ট্যাংকারে করে কিছু ভোজ্য তেল খালাস করে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের স্টোরেজ ট্যাংকে ভর্তি করা হয়। এরপর ট্যাংকারের ড্রাফট ৯ মিটারে নেমে এলে বহির্নোঙর থেকে জেটিতে ভেড়ানো হয়। আবার অনেক সময় বন্দর বহির্নোঙরে থাকা অবস্থায় ছোট লাইটার ট্যাংকারে করে সব ভোজ্য তেল খালাস করা হয়। বহির্নোঙরে খালাস শেষ হয়ে গেলে জেটিতে ভেড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ভোজ্য তেলের জাহাজ আগের মতো নিয়মিত ভিড়ছে চট্টগ্রাম বন্দরে। বহির্নোঙরে এরই মধ্যে ভিড়েছে ভোজ্য তেলবাহী জাহাজ। আরও অন্তত একটি জাহাজ ভিড়তে পারে শনিবার কিংবা রবিবার।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভোজ্য তেলের দাম নিয়ে ক্রেতাদের প্রচণ্ড ক্ষোভ। আর বিক্রেতারা বলছেন, তাদের কাছে ভোজ্য তেলের মজুদ আছে কম। দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। পাইকারদের কাছ থেকে সরবরাহ মিলছে না।
বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী আবু সিদ্দিক বলেন, দামের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসেনি। বরং ভোজ্য তেলের দাম আরও বাড়তির দিকে। সরিষার তেলের দাম প্রতি লিটার ৩২০ টাকা ছাড়িয়েছে। আমরা সরবরাহ কম পাচ্ছি তাই ক্রেতাদের কাছ থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাম বেশি রাখছি।
বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারে বৃহস্পতিবার বিকালে বাজার করতে আসেন ব্যাংকার আবু তৈয়ব। তিনি বলেন, ভোজ্য তেলতো কেনাই কঠিন। যে হারে দাম বেড়েছে তাতে তেল ছাড়া রান্না করার বিকল্প নেই। সরকার বিভিন্ন স্থানে তেলের মজুদদারির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে শুনেছি। কিন্তু বাজারে তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না। উল্টো আরও বাড়ছে। যেন দেখার কেউ নেই।
কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বৃহস্পতিবার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কথা বলে প্রথম দফায় ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানো হয়। অথচ এই যুদ্ধের সঙ্গে ভোজ্য তেলের আমদানি ও দাম বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। মূলত সিন্ডিকেট করেই দাম বাড়াচ্ছে এক শ্রেণির বড় ব্যবসায়ী শিল্প গ্রুপ।
খাতুনগঞ্জের ভোজ্য তেলের পাইকার ব্যবসায়ী মেসার্স আল আমিন স্টোরের মালিক মোহাম্মদ শাহ জালাল বৃহস্পতিবার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভ্যাট ট্যাক্স প্রত্যাহার করায় ভোজ্য তেলের দাম কমবে। কিন্তু এখনই কমবে না। সাধারণ ভোক্তারা কম দামে কিনতে পারবে আরও পরে। তবে ভোজ্য তেলের মজুদ পর্যাপ্ত আছে বলে আমি মনে করি।
টিটি/